দিল্লির ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। সেই প্রতিবাদ-মঞ্চ থেকেই পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণে ‘সাজানো ঘটনা’ তত্ত্বকে কার্যত সমর্থন করলেন তৃণমূলপন্থী নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ।
দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। তার সঙ্গে পা মিলিয়েছে কলকাতাও। শনিবার শহরে এক বিরাট মোমবাতি মিছিল হয়। এ দিন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে প্রতিবাদ-অবস্থান করে নাট্যকর্মীদের সংগঠন ‘নাট্যস্বজন।’ নাট্যমহলে এই সংগঠনটি তৃণমূলপন্থী হিসেবেই পরিচিত। অর্পিতা ছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, বিভাস চক্রবর্তী, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এই সংগঠনের অন্যতম সদস্য। এ দিনের অবস্থানে অবশ্য ব্রাত্যবাবু উপস্থিত ছিলেন না। |
সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। যদি পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষণ কিংবা ইভটিজিং-এর ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রেও আমি নিন্দাই করব।” এই বিবৃতি সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কারণ এই বছরেই পার্ক স্ট্রিট, বরাহনগর, কাটোয়ার ধর্ষণের ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার পরেও মুখ্যমন্ত্রী নিন্দাসূচক বিবৃতি তো দেনইনি। বরং পার্ক স্ট্রিটকে ‘সাজানো ঘটনা’ আখ্যা দিয়েছিলেন এবং কাটোয়া-কাণ্ডে রাজনৈতিক রং খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বভাবতই এ দিন ‘নাট্যস্বজনে’র প্রতিবাদ-কর্মসূচির পরে সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে প্রশ্নগুলি তোলা হয়। তার উত্তর দিতে গিয়েই অর্পিতা মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে কার্যত সমর্থন করেন এবং পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা দিল্লির চেয়ে আলাদা বলে মন্তব্য করেন।
পার্ক স্ট্রিট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পিছনে অভিযুক্তকে শনাক্তকরণের ভুলকেই দায়ী করেছেন অর্পিতা। বলেছেন, “আঙুল তুলতে হলে অভিযোগকারিণীর দিকেই তুলতে হবে। কারণ উনি প্রথমে ভুল লোককে শনাক্ত করেছিলেন।” মমতার সমর্থনে অর্পিতার আরও যুক্তি, “ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর কিন্তু উনি (মমতা) কোনও কথা বলেননি।” অর্থাৎ সত্য জানার পরে মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতাকেই তাঁর পক্ষপাতহীনতা বলে তুলে ধরতে চাইছেন অর্পিতা। অথচ সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্ট জনেদের বক্তব্য হল, এক বার ‘সাজানো ঘটনা’ বলার পরে ওই ভাবে চুপ করে থাকাটা সমর্থনযোগ্য নয়। মুখ্যমন্ত্রীর ভুল স্বীকার করা উচিত ছিল। যেমন, রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “অভিযোগকারিণী দোষীদের ঠিক মতো শনাক্ত করতে না পারলে বিচারকের সমস্যা হতে পারে। আর কারও সমস্যা হওয়ার কথা নয়!” সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছিলেন, তখনই কেমন লেগেছিল! তার পরে সব জেনেশুনে কিছু বললেন না দেখে খুব আশ্চর্য হই।”
অর্পিতার এই মন্তব্যের সূত্র ধরে পার্ক স্ট্রিট তদন্তে অন্যতম প্রধান ভূমিকা নেওয়া তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনের প্রসঙ্গও এ দিন নতুন করে উঠে এসেছে। অর্পিতা নিজে দময়ন্তী-প্রসঙ্গ তোলেননি। কিন্তু এ দিন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সমর্থনে বক্তব্য রাখার পরে অনেকেরই মনে পড়ে গিয়েছে, কী ভাবে দময়ন্তীকে বদলি হয়ে যেতে হয় ডিআইজি (প্রশিক্ষণ)-এর মতো তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে। নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ এ দিন প্রশ্ন তোলেন, “তদন্তে উদ্যোগী হয়ে যদি দময়ন্তী সেনকে প্রশাসনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, তা হলে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত চার্জ গঠন না হওয়ার জন্য কেন কাউকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে না?”
দিল্লির ঘটনার সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার প্রেক্ষিত এবং গতিপ্রকৃতির তফাতের কথা উল্লেখ করেছেন অর্পিতা। তাঁর কথায়, “পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডে অভিযোগকারিণী মহিলা মধ্যরাতে স্বেচ্ছায় একটি গাড়িতে উঠেছিলেন। আর দিল্লিতে অভিযোগকারিণী রাত সাড়ে ন’টায় একটি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে যাচ্ছিলেন।” অর্পিতার বক্তব্য শুনে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে কি পরিচিত-অপরিচিত-স্বল্প পরিচিতদের সঙ্গে গাড়িতে উঠলে ধর্ষণের অপরাধমূল্য কমে যায়? অর্পিতার কথায়, তিনি সেটা বলতে চাইছেন না। তিনি শুধু বলতে চাইছেন, ভারতের মতো দেশে মহিলাদের প্রতি ‘পারসেপশন’ বিভিন্ন ঘটনায় আলাদা হয়ে থাকে। অর্পিতা নিজে কি ওই ‘পারসেপশন’ বা দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন? তাঁর কথায়, “আমি মনে করি দু’টি ঘটনাই নিন্দনীয়। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাটির স্বরূপ বুঝতে দেরি হয়েছিল।” কারণ, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযোগকারিণী প্রথমে ভুল লোককে দোষী বলে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু দিল্লির ঘটনায় অভিযুক্তদের শনাক্তকরণে কোনও বিভ্রান্তি হয়নি। তাই দু’টি ঘটনার ‘গতিপ্রকৃতি’তে তফাত আছে বলে মনে করেন তিনি। সেই কারণেই পার্ক স্ট্রিটের বেলায় তেমন ভাবে প্রতিবাদ দানা বাঁধেনি বলেও তাঁর দাবি। |
কিন্তু ‘গতিপ্রকৃতি’র তফাতের কারণে প্রতিবাদের তারতম্য হওয়াটা কি কাম্য? সমাজতত্ত্বের প্রবীণ অধ্যাপক প্রশান্ত রায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ধর্ষণ ধর্ষণই। ঘটনার গতিপ্রকৃতির তফাতটা প্রধান বিবেচ্য নয়।” ‘নাট্যস্বজনে’র এ দিনের প্রতিবাদে অংশ নেওয়া প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তী বলেন, “অর্পিতা যা বলেছেন, সেটা ওঁর ব্যক্তিগত মত!” বিভাসবাবুর ব্যক্তিগত মতটা কী? “যে কোনও ধর্ষণের ঘটনাই সমান ভাবে নিন্দাজনক।”
অথচ ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-মঞ্চ থেকেই অর্পিতা এ দিন যে ভাবে পার্ক স্ট্রিট মামলায় মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে সমর্থন করলেন, তাতে প্রতিবাদেও সংকীর্ণ রাজনীতির ছাপই এসে পড়ল বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, পার্ক স্ট্রিট মামলায় শনাক্তকরণ সংক্রান্ত যে জটিলতা ছিল, কাটোয়ার ধর্ষণ মামলায় তা ছিল না। কিন্তু সেখানেও মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আলাদা কিছু ছিল না।
পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার অব্যবহিত পরেই কাটোয়ার ধর্ষণের ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ওই মহিলার স্বামী সিপিএম করেন। তৃণমূলকে হেনস্থা করার উদ্দেশ্যেই এ সব ঘটনা সাজানো হচ্ছে। অথচ পরে জানা যায়, ওই মহিলার স্বামী দীর্ঘদিন আগে মারা গিয়েছেন। তিনি কংগ্রেস করতেন। এ প্রসঙ্গে নাট্যপরিচালক কৌশিক সেন বলেন, “কাটোয়ার ক্ষেত্রে তো ভুল লোককে শনাক্ত করা হয়নি, ওই মহিলা মধ্যরাতে কারও প্রাইভেট গাড়িতেও যাচ্ছিলেন না! সেখানে সাজানো ঘটনা বলা হল কেন?” কেন্দ্রের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী মেয়েদের উপরে অত্যাচার-ধর্ষণ-নিগ্রহের ঘটনায় এ রাজ্য দ্বিতীয় স্থানে। তার উপরে একের পর এক ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর নানা অসংবেদনশীল মন্তব্য প্রশাসনের ভূমিকাকে বারংবার প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে বলেই মনে করেন রাজ্যবাসীর একটা বড় অংশ। এ দিন অর্পিতার কথায় সেটাই আরও এক বার প্রমাণ হল এবং সমর্থন পেল বলে মনে করছেন তাঁরা। |