আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায় মাটির উপরিভাগের জল বেশি ব্যবহার করা ও হারিয়ে যেতে বসা চুনো মাছের চাষ বাড়ানোর উদ্দেশে দ্বাদশ ‘খালবিল ও চুনো মাছ উৎসব’ শুরু হল পূর্বস্থলীতে। মঙ্গলবার থেকে দু’দিনের এই উৎসব শুরু হয়েছে। প্রথম দিন উৎসবে এসেছিলেন রাজ্যের ক্ষুদ্রশিল্প, ভূমি ও বস্ত্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, মৎস্য দফতরের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের প্রতিমন্ত্রী পুন্ডরীকাক্ষ সাহা-সহ বেশ কয়েক জন বিধায়ক। ছিলেন জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা এবং মৎস্য দফতরের রাজ্য ও জেলা স্তরের আধিকারিকেরা।
এ দিন সকাল ৯টা থেকে উৎসব শুরু হয়। যেখানে এই উৎসব হচ্ছে সেই বাঁশদহ বিলে দু’টি নৌকায় ভাসমান মঞ্চ তৈরি হয়। সূর্যোদয়ের পর থেকেই মঞ্চে বাউল, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি-সহ নানা গান শুরু হয়। |
বিলের দু’দিকের পাড়েও মঞ্চ বাঁধা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হয় শাপলা ফুল ও মাটির হাঁড়ি ভর্তি খেজুর গুড় দিয়ে। বিলের পাড়ে একটি ক্যাম্প থেকে তিন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বেশ কিছু মৎস্যজীবীকে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। মৎস্য দফতরের উদ্যোগে এলাকায় একটি মাটি ও জল পরীক্ষাগার খোলা হয়। সেখানে কোন কোন জলাশয় কী ধরনের মৎস্যচাষের উপযোগী, সে ব্যাপারে এই দু’দিন পরামর্শ দেওয়া হবে।
মৎস্যমন্ত্রী এ দিন বাঁশদহ বিলে ল্যাটা, সিঙ্গি, মাগুর-সহ আট রকম চারাপোনা ছাড়েন। খালবিল উৎসব কমিটির সম্পাদক তথা মন্ত্রী স্বপনবাবু অনুষ্ঠানে বলেন, “নবদ্বীপ এলাকায় প্রচুর পর্যটক আসেন। তাঁদের একাংশ পূর্বস্থলী ১ ব্লকে চৈতন্য-স্মৃতি বিজড়িত নানা স্থান এবং বাঁশদহ ও চাঁদের বিল দেখতে আসেন। তাই বাঁশদহ বিলের কাছাকাছি কোনও পর্যটন আবাস তৈরি করা গেলে পর্যটকদের উৎসাহ বাড়বে। নৌকাবিহার ও নানা সৌন্দর্যায়নের ব্যবস্থা হলেও ভাল হবে।” এ ব্যাপারে উদ্যোগের জন্য তিনি মৎস্যমন্ত্রীক অনুরোধ করেন। বিলে যাওয়ার জন্য রাস্তা তৈরির দাবিও জানান তিনি। বুধবারই রাস্তাটির ব্যাপারে কাজ শুরুর নির্দেশ দেওয়া হবে বলে চন্দ্রনাথ সিংহ জানান।
স্বপনবাবু জানান, গত বছর একশো দিনের প্রকল্পে বিল সংস্কার হয়েছে। তার ফলে এই বিলে মাছচাষের সঙ্গে আশপাশের জমিতে চাষের কাজেও জল ব্যবহৃত হচ্ছে। পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণ বাড়ছে। অনুষ্ঠানে রাজ্য থেকে হারিয়ে যেতে বসা চুনো মাছ নিয়েও আলোচনা হয়। চন্দ্রনাথবাবু জানান, রাজ্যে মৎস্য দফতরের ১৬টি লজ রয়েছে। পূর্বস্থলীতেও একটি গড়ার উদ্যোগ চলছে। মন্ত্রী আরও জানান, রাজ্যে প্রায় এগারোশো মৎস্য সমবায় রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় চারশোটি ঠিক মতো কাজ করছে। বাকিগুলি কী অবস্থায় রয়েছে, তা দেখা হচ্ছে। চন্দ্রনাথবাবু স্বীকার করেন, “বাজারে চুনো মাছ কমে যাচ্ছে। তা যাতে বাড়ানো যায়, তার চেষ্টা চলছে।”
২০০১ সালে এলাকায় যখন আর্সেনিক আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সেই সময়ে স্বপনবাবুর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই খালবিল উৎসব। মাটির উপরিভাগের জল বেশি ব্যবহার করার জন্য সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা হয় উৎসবে। স্বপনবাবু এ দিন বলেন, “পূর্বস্থলী ১ ব্লকে এখনও পর্যন্ত আর্সেনিকের প্রকোপে ২১ জন মারা গিয়েছেন। আরও দেড়শো মানুষ আর্সেনিকোসিসে ভুগছেন।” তাঁর দাবি, পূর্বস্থলীর বাঁশদহ বিলে বছর আটেক আগে যেমন একটি পানীয় জলের প্রকল্প তৈরি হয়, তেমন আরও কয়েকটি প্রকল্প হলে এলাকার প্রায় ২৫টি গ্রাম বিশুদ্ধ জল পাবে। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরকে উদ্যোগের আহ্বান জানান তিনি। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার আশ্বাস, গত বছর যে ভাবে একশো দিনের কাজে এই বিল সংস্কার হয়েছিল, জেলার অন্যত্র এমন উদ্যোগ হলে প্রশাসন পাশে থাকবে। এ দিন দুপুরে অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল অন্য একটি ভাসমান মঞ্চে। খাবারের তালিকায় ছিল বিলের চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া, নলেন গুড়ের পায়েস ইত্যাদি। আজ, বুধবার সকালে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হবে। সন্ধ্যায় বিলের জলে প্রদীপ ভাসিয়ে শেষ হবে এ বারের উৎসব। |