বিদায়লগ্নে শেষ দেখা!
ষাট বছর আগের এ রকম এক ডিসেম্বরেই ছটফটে ভিলিয়ার অনামিকায় ‘বিয়ের আংটি’ পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মুখভার আকাশের দিকে চেয়ে রবিবার গোটা দিন তাঁর প্রতীক্ষাতেই তো বসেছিলেন বিরাশি বছরের বৃদ্ধা ভিলিয়া।
বিকেল চারটে দশ। ম্যাকলয়েড স্ট্রিটের বাড়ির দরজায় হাজির তিনি। শববাহীযানে চিরনিদ্রায় শায়িত অবস্থায়। অশক্ত শরীরে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে এলেন ভিলিয়া ক্লডিয়াস। এক হাত ওয়াকারে। আর এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে ছেলে ব্র্যান্ডনকে। স্বামী লেসলির নিথর দেহের সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় তিরিশ সেকেন্ড। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। তার পরেই মাথা নিচু করে সিঁড়ির পথ ধরলেন লেসলি ক্লডিয়াসের স্ত্রী। আর বাংলার সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদকে নিয়ে গাড়ি ছুটল মল্লিকবাজারের কবরখানার দিকে। সজল নয়নে তখন রাস্তার ট্রাফিক সামলাচ্ছেন সত্তর দশকে ক্লডিয়াসের কাছে হকি শিখতে যাওয়া জাভেদ খান। এখন রাজ্যের দমকলমন্ত্রী।
বিকেল চারটে পঞ্চাশ। ক্লডিয়াসের কফিন নেমে গেল কবরে। ১৯৭৮ থেকে যেখানে শুয়ে রয়েছেন তাঁর বিশ্বকাপার ছেলে রবার্ট। ছেলের কবরের উপরে সমাহিত করা হল ভারতীয় হকির ‘স্প্যারো’কে। দুই যাজক নাইজেল পোপ এবং সিমিক অস্টিন পাঠ করলেন বাইবেল। ছলছল চোখে কাঁপা গলায় ‘নিয়ারার মাই গড টু দি’ গেয়ে ‘আঙ্কল লেসলি’কে বিদায় জানালেন গুণমুগ্ধরা। |
সকাল দশটা চল্লিশে ‘পিস হাভ্ন’ থেকে শেষযাত্রার সূচনা। প্রথমে কাস্টমস তাঁবু। সেখানেই মালা দিয়ে অভিন্নহৃদয় বন্ধু অলিম্পিয়ান কেশব দত্তর প্রতিক্রিয়া, “আর হকির কথা বলব না।” মরদেহে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের পতাকা বিছিয়ে দেওয়ার ফাঁকেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বেঙ্গল হকি অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের পাশপাশি লক্ষ্মীরতন-সৌরাশিসের মতো বাংলার রঞ্জি ক্রিকেটারদের।
সাড়ে এগারোটায় ভেটারেন্স তাঁবু। সেখানে মালা দিলেন চুনী, বদ্রু, সুব্রত, অরুণ ঘোষ, শ্যামল সেনরা। মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসাবে মাল্যদান করেন গোটা যাত্রার সঙ্গী ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র।
বারোটা থেকে একটা পঞ্চাশ। দেহ রইল রবীন্দ্রসদনে। উত্তরপাড়া থেকে সেখানে ছুটে এসে মালা দেওয়ার পর তুলসীদাস বলরামের স্মৃতিচারণ, “দেখলেই বলতেন, কলকাতা কখনও ছেড়ো না।” পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেখানেই পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে গেলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন দেবরা।
এরই ফাঁকে বিএইচএ সভাপতি গৌতমমোহন চক্রবর্তীর সোজাসাপটা স্বীকারোক্তি, “আর্থিক অসুবিধা ছাড়া যদি ক্লডিয়াসকে বিএইচএ ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ গাড়ি দিয়ে থাকে, তা হলে সেটা ভুল হয়েছে।” ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে বিএইচএ কর্তাদের দাবি, নিউমার্কেটে ক্লডিয়াসের মর্মর মূর্তি স্থাপনের পাশাপাশি এলাকার নাম হোক ‘লেসলি ক্লডিয়াস চক’। যা বিবেচনা করার আশ্বাস দিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী।
রবীন্দ্রসদন থেকে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল। ৪৫ মিনিটের পারিবারিক ধর্মীয় আচার আয়োজন। সেখান থেকে শেষযাত্রা যখন মল্লিক বাজারের দিকে ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। এগিয়ে আসছে প্রিয় কলকাতার মাটিতে লেসলি ওয়াল্টার ক্লডিয়াসের নশ্বর দেহ মিশে যাওয়ার মুহূর্ত। ক্রীড়াপ্রেমীদের হাতে প্ল্যাকার্ড, ‘বিদায় লেসলি’। যা দেখে সুব্রত ভট্টাচার্য বললেন, “হৃদয়ে প্রেমের আসনে যার স্থান, মৃত্যুর শাসনে তাঁর বিদায় হয় না।” সত্যিই তো, কিংবদন্তির কখনও মৃত্যু হয় নাকি? প্রজন্মভর তাঁরা অমর। যেমন লেসলি ক্লডিয়াস। |