না, সে দিন ডিনার টেবিলে বসে একবারও বুঝতে পারিনি, দু’সপ্তাহ পরেই সচিন ক্রিকেট থেকে আংশিক অবসর নেবে। নিজে বুঝতে দেয়নি। আমি বুঝতে চাইওনি।
আসলে সচিনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যে রকম, তাতে ওর সঙ্গে দেখা হলে বা দু’জনে আড্ডায় বসলে ক্রিকেট নিয়ে বেশি কথা হত না। ওর পারফরম্যান্স, ফর্ম বা এখনকার ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে তো একেবারেই নয়। ক্রিকেটের বাইরের বিষয় নিয়েই বেশি আলোচনা হয় আমাদের মধ্যে। সে জন্যই সে দিন নৈশভোজের আড্ডায় এক বারের জন্যও জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি, কবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছ?
এই তো দিন পনেরো আগের ঘটনা হবে। ইডেন টেস্টের ঠিক আগেই। মুম্বইয়ে ডিনারে ওর নেমন্তন্ন পেয়ে গেলাম। দু’তিন ঘন্টার আড্ডা হল। নিখাদ আড্ডা। সিনেমা, গান-বাজনা, লতা মঙ্গেশকরের উত্তরসূরি কে হতে পারে। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা থেকে বব মার্লি। বিভিন্ন মাছের জাপানিজ রেসিপি। আড্ডা মারতে মারতে কোথায় না কোথায় পৌঁছে গিয়েছি আমরা। দিব্যি হাসিখুশি, প্রাণখোলা সচিনকে দেখে কে বুঝবে যে, তার মনের ভিতর ক্রিকেট ছাড়া নিয়ে দোলাচল চলছিল?
ক্রিকেট ছাড়া! আজ ওর ওয়ান ডে থেকে অবসরের দিনেও ক্রিকেটহীন সচিনের কথা ভাবতে পারছি না। ওয়ান ডে খেলবে না, টেস্ট ক্রিকেট তো খেলবে। সেও অবশ্য কত দিন আমি জানি না। তবু তার পরেও যে ক্রিকেট ওকে ছাড়বে, তা বিশ্বাস করি না। সচিনও ক্রিকেটকে ছাড়তে পারবে বলে মনে না। কোনও না কোনও ভাবে ক্রিকেটের সঙ্গে ও থাকবেই। কারণ, ক্রিকেট ওর রক্তে, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ক্রিকেট ছাড়া ও বাঁচবে না। |
তাই বলে ক্রিকেটই যে ওর প্রতি মুহূর্তে মাথায় চেপে বসে থাকে, তা কিন্তু নয়। ক্রিকেটকে ও সত্যিই উপভোগ করতে চায় বলেই মাঝে মাঝে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যেতে চায়। ঘরোয়া আড্ডায় তাই ক্রিকেটের প্রবেশ নিষেধ। সে দিন নৈশভোজের আড্ডাতেও সেই নিয়মের অন্যথা হয়নি। ওর মুখে বিভিন্ন খাবারের গল্প শুনে আমি তো বলেই ফেললাম, “একদিন তোমার বাড়িতে যাব তোমার রান্না খেতে। নিজে রান্না করে না খাইয়ে, শুধু খাওয়ার গল্প শোনালে হবে না।” তাতে সচিন কম খুশি হল না। বলল, “অবশ্যই এসো। সময় পাই। ঠিক ডেকে খাওয়াব তোমাদের।” এ বার নিশ্চয়ই ও আগের চেয়ে বেশি সময় পাবে। সচিন তেন্ডুলকরের হাতের রান্না খাবার সৌভাগ্যও হবে নিশ্চয়ই।
‘বড়া আদমি’ না বলে কেন সচিনকে ‘বড়া দিলওয়ালা আদমি’ বলা হয়, গণপতি উৎসবের দিন নিজের বাড়িতে ওর অতিথি আপ্যায়ন দেখে বুঝেছিলাম। মুকেশ অম্বানি থেকে শুরু করে মুম্বই রঞ্জি দলের সতীর্থ প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলা, বিদায় দেওয়ার সময় ওর প্রত্যেক অতিথিকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সৌজন্যবোধ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
এমনিতেই হাসিখুশি, তার ওপর বিশ্বকাপ জেতার পর ওকে আরও বেশি হাসিখুশি মনে হয়েছিল। আসলে বিশ্বকাপ হাতে তোলাটা ছিল ওর জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পর ও ক্রিকেটকে আরও বেশি করে উপভোগ করতে শুরু করে। যদিও সম্প্রতি কয়েক দিন ধরে ওকে নিয়ে নানা মহলে নানা রকম আলোচনা চলছিল, কিন্তু সে সব ওকে ছুঁতে পারেনি। বেশ কয়েক বার টেক্সট মেসেজ করেছিলাম, “তোমার পাশে আছি। চিন্তা কোরো না। কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার হলে বুঝেশুনেই নিও।” উত্তরে শুধু ‘থ্যাঙ্কস’ ছাড়া আর কিছু লিখত না। সিদ্ধান্তটা নিয়ে ও সম্ভবত কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি, পুরোপুরি একার সিদ্ধান্ত।
রাতের দিকে শুনছিলাম ওর উপর নাকি সিদ্ধান্তটা চাপানো হয়েছে খানিকটা। সচিনকে জিজ্ঞেস করার সময় এটা নয়। তবে একান্তে হলে অবশ্যই জানতে চাইব, সত্যিটা কী। |
(লেখক মরাঠি ক্রিকেটলিখিয়ে, সচিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পাপ্পু নামে পরিচিত।) |