রবিবার মধ্যাহ্নে রাজধানীর রাজপথে সমবেত প্রতিবাদীদের এক জনকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনারা ঠিক কী চাহিতেছেন? দিল্লির গণধর্ষণে অভিযুক্তদের বিচার এবং সাধারণ ভাবে মেয়েদের নিরাপত্তাবিধানের প্রশ্নে সরকার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, তাহাতে কি আপনি সন্তুষ্ট?’ প্রশ্নের উত্তরে প্রতিবাদী তরুণীর তীব্র, বেপরোয়া এবং অসহিষ্ণু মন্তব্য: আমি জানি না, আমি নিরাপত্তার দাবি জানাই। জবাবটি প্রতীকী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। গত এক সপ্তাহে দিল্লিতে এবং ক্রমশ দেশের অন্য নানা শহরেও যে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ, তাহার সম্পর্কে বহু প্রশ্ন তোলা যায়। প্রতিবাদীদের একটি বড় অংশ ‘ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি, এখনই ওই দুর্বৃত্তদের ফাঁসি দিতে হইবে’ বলিয়া যে শোরগোল করিতেছেন, তাহা স্পষ্টতই অসহিষ্ণুতার পরিচায়ক, যে অসহিষ্ণুতা আইন-আদালতের নিজস্ব পদ্ধতিকে সম্মান জানাইতে রাজি নহে, যাহা কার্যত ‘জনতার আদালত’-এ অবিলম্বে দণ্ডাজ্ঞা চাহে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হইতে শুরু করিয়া এক সময় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বেষ্টনী ভাঙিয়া ‘সদর দফতর’ আক্রমণের যে উদ্যোগ, তাহাও সরাসরি আইন অমান্য করিবার অভিযান। রাষ্ট্র এই অনাস্থাকে মানিয়া লইতে পারে না, মানিয়া লইলে তাহার শাসনের ভিত টলিয়া যায়, রাষ্ট্রযন্ত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হইয়া পড়ে। সুতরাং লাঠি, গ্যাস, জলকামান, অবাঞ্ছিত হইলেও, অহেতুক বা অপ্রত্যাশিত ছিল না।
কিন্তু ভারতীয় রাষ্ট্র যাঁহারা চালাইতেছেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই জানেন, লাঠি, গ্যাস, জলকামান দিয়া শাসনযন্ত্রটিকে রক্ষা করা যায়, যন্ত্রীদের নৈতিক অধিকার রক্ষা করা যায় না। প্রতিবাদী বিক্ষোভ যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিণাম নয়, তাহা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং ক্রোধের প্রকাশ। সেই ক্ষোভ এবং ক্রোধ কোনও একটি সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়, তাহা রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যবস্থাটির বিরুদ্ধে, যে ব্যবস্থা নাগরিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করিতে অক্ষম, এবং সেই অক্ষমতা লইয়া যাহার কিছুমাত্র লজ্জা বা অনুশোচনা নাই, সুতরাং প্রতিকারের কোনও তাগিদ নাই। এই ব্যাপক এবং গভীর নাগরিক ক্ষোভকে আপন স্বার্থে ব্যবহার করিবার জন্য সুযোগসন্ধানীরা কতটা তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন, সে প্রশ্ন উঠিতেই পারে। বিরোধী দলনেত্রী সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকিবার দাবি জানাইয়া শাসক দলকে বিপাকে ফেলিতে চাহিতেছেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোলা জলে মাছ ধরিতে লোক পাঠাইতেছেন। এমনকী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কঠোর সমালোচনা করিতেছেন দিল্লি পুলিশের, যে পুলিশ তাঁহার অধীন নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন, এবং প্রসঙ্গত লক্ষণীয়, শীলা দীক্ষিতের সহিত কংগ্রেসের হাই কমান্ডের সম্পর্ক মধুর ও নিষ্কণ্টক বলিয়া কোনও জনশ্রুতি রাজধানীতে প্রচলিত নাই। এ সকলই সত্য। কিন্তু তাহাতে বৃহত্তর এই সত্যের মূল্য এক বিন্দুও কমে না যে, নাগরিক ক্ষোভের এই বিস্ফোরণ অত্যন্ত স্বাভাবিক।
রাষ্ট্রযন্ত্র ও তাহার যন্ত্রীদের উপর ইহার কোনও সুপ্রভাব পড়িবে কি? কেন্দ্রীয় সরকার ভয় পাইয়াছেন এবং আগুন নিভাইবার চেষ্টা করিতেছেন। শনিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া এক গুচ্ছ প্রশাসনিক বন্দোবস্তের ঘোষণা, আপন বেদনা ও সঙ্কল্প উচ্চারণ এবং বিক্ষোভকারীদের শান্ত থাকিতে ‘মিনতি’ জানানো, রবিবার প্রতিবাদীদের প্রতিনিধিদলের সহিত সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর সাক্ষাৎ ও ‘সহৃদয়’ আলোচনা রাজপথের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাইবার উপক্রম না হইলে যে ইহার কিছুই ঘটিত না, ভারতে গড়পড়তা প্রতি বাইশ মিনিটে সংঘটিত এক একটি ধর্ষণের ইতিহাসে আরও একটি ঘটনামাত্র যুক্ত হইত, তাহাতে প্রতিবাদীদেরও সংশয় নাই, বোধহয় সরকারি কর্তাদেরও নাই। রাষ্ট্র আপাতত কোণঠাসা, সুতরাং বিস্তর পবিত্র ক্রোধ, অনুতাপ এবং প্রতিশ্রুতির প্লাবন বহিবে। দিল্লির ঘটনাটির বিচারপ্রক্রিয়া এবং দণ্ডদানও হয়তো দ্রুত সম্পন্ন হইবে, বিশেষত অভিযুক্তরা যেহেতু প্রভাবশালী সমাজের সদস্য নয়। কিন্তু ভারতে রাজধানী হইতে প্রত্যন্ত গ্রামে মেয়েদের নিরাপত্তা? ভারতীয় নাগরিকরা দিল্লির ওই তরুণীর প্রতিধ্বনি করিয়া বলিবেন: জানি না। রাষ্ট্রের উপর অবিশ্বাস হারানো পাপ। |