|
|
|
|
সনিয়াদের আশ্বাস বৃথা, পথে পথে চলল লড়াই |
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
হায়দরাবাদ হাউসের সামনেই ঝুলছে বিরাট পোস্টারটা। ‘পুলিশ, তোমার কাঁদানে-বোমার প্রয়োজন নেই। আমাদের চোখ এমনিতেই অশ্রুসিক্ত।’
অশ্রু এখন ঘৃণার আগুন। জলকামান-লাঠির বাড়ি-কাঁদানে গ্যাসের সামনে পড়ে সে আগুন আরও গনগনে। গোটা শহর জুড়ে খণ্ডযুদ্ধ। বহু যুদ্ধের সাক্ষী দিল্লি এমনটা দেখেনি সাম্প্রতিক ইতিহাসে।
পাল্টা? আরও লাঠি, আরও কাঁদানে গ্যাস, আরও জলকামান। মেয়েদের চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে সরানো! কেউ কেউ টিভি ক্যামেরার সামনে বলে উঠল, “ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে এসেছি। আজ পুলিশ আর এক বার ধর্ষণ করল আমাদের।”
প্রায় ৬৫ জন প্রতিবাদী আহত হয়েছেন এ দিন। আহত হয়েছেন ৭৮ জন পুলিশও। দুই কনস্টেবলের শারীরিক অবস্থা গুরুতর।
|
|
থামছে না বিক্ষোভ। এ বার তা হয়ে উঠল মারমুখী। পুলিশের দিকে
বাঁশ ছুড়ছেন এক প্রতিবাদী। রবিবার ইন্ডিয়া গেটের সামনে। ছবি:এ পি |
কেন এমন মারমুখী হয়ে উঠল আন্দোলন? পর্যবেক্ষকরা তিনটে কারণ দিচ্ছেন। এক, বাড়াবাড়ি রকম পুলিশি আক্রমণ। সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে গিয়েছে। দুই, বিক্ষোভের দলে ভিড়ে গিয়েছে কিছু গুন্ডার দল, কিছু রাজনৈতিক ক্যাডারও। এমন নেতৃত্বহীন গণবিক্ষোভে যা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তিন, প্রশাসনের নির্লিপ্ততা।
গত কাল সারা দিন দফায় দফায় দাবি উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী এক বার আসুন। মনমোহন সিংহ আসেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে সাংবাদিক বৈঠক করে দায়িত্ব সেরেছেন। এ দিন রাতে মনমোহন অবশেষে বিবৃতি দিলেন। মেনে নিলেন, মানুষের রাগের সঙ্গত কারণ আছে। স্বীকার করলেন, পুলিশের সঙ্গে এই সংঘাতের ঘটনায় তিনি ব্যথিত। প্রতিশ্রুতি দিলেন, মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে সরকার সব রকম ব্যবস্থা নেবে। রাতেই নির্যাতিতা তরুণীর বাবাও টিভি মারফত প্রতিবাদীদের অনুরোধ করলেন, শান্ত থাকতে, পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করতে।
এ সবের আগে গত বারো ঘণ্টায় অবশ্য দু’-দু’বার সনিয়া গাঁধী দেখা করেন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। দেখা করেন রাহুলও। কংগ্রেস নেতাদের আশা ছিল, সনিয়া-রাহুল দেখা করলে উত্তেজনা কমবে। রাজধানী দেখাল, অনুমান কতটা ভুল ছিল।
গত কাল মধ্যরাতে সনিয়া ১০ জনপথ থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলেন। আজও কিছু ছাত্রছাত্রী দেখা করেন সনিয়ার সঙ্গে। সনিয়া নাম জানতে চাওয়ায় তাঁরা বলেন, নামে কী আসে যায়? কংগ্রেস সভানেত্রী আশ্বাস দেন, তিনি তাঁদের পাশে রয়েছেন। ন্যায়বিচার হবে। এক ছাত্রের কথায়, “সনিয়া জানিয়েছেন, তাঁরা কিছু না কিছু করবেন। তবে কবে সেটা হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না।” |
|
প্রতিবাদীদের সঙ্গে কথা বলছেন সনিয়া। ছবি: পি টি আই |
এই আশ্বাসবাক্য উত্তেজনা কমাতে পারেনি। কেন? শুধুই কি প্রতিবাদীদের মধ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক নেতৃত্বের অভাবে? সেটা একটা কারণ হতে পারে। রামদেব বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালরা বিক্ষোভে যোগ দিলে কী হবে, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব ওঁদের হাতেও নেই (কেজরিওয়ালের হয়ে জনতার কাছে যেতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খান প্রাক্তন সেনাপ্রধান ভি কে সিংহ)। এবং এর কারণটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রতিবাদীরাই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেকটা গত কালই যা বলছিলেন ওমর আবদুল্লা! আজ এক বিক্ষোভকারী বলছিলেন, পুরো একটা সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরে সনিয়া-রাহুল কিছু আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি ম্যাজিকের মতো বদলে দেবেন, এটা আর সম্ভব নয়। বিশেষত যেখানে পুলিশ ইতিমধ্যেই দমনপীড়নের রাস্তা নিয়ে ফেলেছে। পুলিশের এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতও। পুলিশ কমিশনার নীরজ কুমারকে সরতে হতে পারে, এমনও ইঙ্গিত দেন তিনি। এ সব কথা প্রকাশ্যে বলায় কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর একটা টানাপোড়েনও তৈরি হয়েছে।
রাতে এই খবর লেখার সময়ও আনন্দবাজার অফিসের বাইরে (যা কিনা সংসদ এবং রেলভবন থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে) রফি মার্গে অব্যাহত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। দলে দলে মানুষ রেলভবন, সংসদ কর্ডন করে রাখা পুলিশ-ব্যূহের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। চলছে আধলা ইট-বিনিময়, লাঠি চার্জ এবং পুলিশকে গালিগালাজ। যেখানে সাংবাদিকদের অহরহ যাতায়াত, সেই শাস্ত্রী ভবনের সামনে একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেলের মহিলা সাংবাদিককে লাঠিচার্জের মুখে পড়তে হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁর ক্যামেরা ও সরঞ্জাম। অদূরে ভিপি হাউসের সামনে যান নিয়ন্ত্রণের জন্য রাখা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে চলছে গণ-প্রস্রাব।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ইন্ডিয়া গেট, রাইসিনা হিল, রেলভবন, কোপার্নিকাস মার্গ, বিজয় চক সর্বত্র। রাত ১০-২০ নাগাদ পুলিশ গিয়ে ইন্ডিয়া গেটের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের তুলে নিয়ে সরিয়ে দেয়। “পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা যেন গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা সাধারণ মঞ্চ পেয়ে গিয়েছে। এখানে এমন অনেকেই আসছেন যাঁরা বা যাঁদের নিকট জন, বিভিন্ন নারী নির্যাতনের ঘটনায় ভুক্তভোগী। অথচ ন্যায়বিচার পাননি,” বিকেলে বলছিলেন দলবীর কৌর। হায়দরাবাদ হাউসের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতির দিকে নজরে রাখছিলেন লাজপত নগরের এই বস্ত্র ব্যবসায়ী।
|
|
মানুষের রাগ ও যন্ত্রণার সঙ্গত কারণ আছে। পুলিশ এবং
প্রতিবাদীদের
মধ্যে যে ভাবে সংঘর্ষ হয়েছে, তাতে আমি
অত্যন্ত ব্যথিত।
কথা
দিচ্ছি, দেশ জুড়ে মহিলাদের
নিরাপত্তা দিতে আমরা সব
রকম ব্যবস্থা নেব।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ |
|
নিজেও হাতে নিয়েছেন একটি পোস্টার। তাঁরই পাশে দাঁড়ানো মণীশ চোপড়া (পেশায় সরকারি চাকুরে) দলবীরকে সমর্থন করলেন, “বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার চিত্রটিই এ ভাবে রাজধানীতে আছড়ে পড়ল।”
কথা থমকে যাচ্ছে পাঁচ মিনিট অন্তর কাঁদানে গ্যাসের আওয়াজে। দলে দলে পুলিশের তাড়া খেয়ে
দৌড়ে যাওয়া মানুষের ঢল। তার ঠিক পরেই পাল্টা গালিগালাজ এবং ইট বর্ষণ। আন্দোলনের স্নায়ুকেন্দ্র অবশ্যই ইন্ডিয়া গেট। হায়দরাবাদ হাউসের সামনে অভিজাততম রাস্তা বারাক ওবামা থেকে ভ্লাদিমির পুতিন, বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনায়কের গাড়ি যার উপর দিয়ে যাতায়াত করেছে আজ সেখানে শুয়ে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। ২৬শে জানুয়ারির মহড়ার জন্য জড়ো করা বেঞ্চিগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পোস্টার হাতে মহিলা বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন গায়ত্রী পান্ডে। পূর্ব দিল্লির ময়ূর বিহার অঞ্চলের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মহিলাদের জড়ো করে সকালবেলাই চলে এসেছিলেন যন্তরমন্তরে। সেখানে অনুমতি পাননি, তাই ইন্ডিয়া গেটে সামিল হয়েছেন অন্যদের সঙ্গে। ভাঙা গাড়ির সামনে অসহায় মুখে দাঁড়ানো এক পুলিশ কর্তাকে দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। “প্রতিদিন ধর্ষণ, ইভ টিজিং-এর ঘটনার সময় আপনাদের টিকির দেখা যায় না। আজ এসেছেন, প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করতে?” জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনা মুখোপাধ্যায় এসেছেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে। বলছেন, “যাতে এই চাপের মুখে ধর্ষণের আইন কঠোর করার সিদ্ধান্ত হয়, তারই চেষ্টা করছেন সবাই। ধৌলাকুঁয়াতেও নৃশংস ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল কয়েক বছর আগে। কিছু দিনের হইচই-এর পর সব থেমে যায়।”
এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখে পড়ে রীতিমতো দিশেহারা দেখাচ্ছে সরকারকে। দফায় দফায় বৈঠক চলছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশাল কুমার শিন্দের সঙ্গে বসেছিলেন মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যরা। পরে মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের সঙ্গে পৃথক ভাবে বৈঠক করেছেন শিন্দে। সকালে সনিয়া যখন ছাত্রদের সঙ্গে দেখা করেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ। বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজও কথা বলেছেন শিন্দের সঙ্গে।
গত কাল এবং আজ ছিল ছুটির দিন। আটটা স্টেশনে মেট্রো বন্ধ রেখেও স্রোতের মতো লোক আসা ঠেকানো যায়নি। কাল, সোমবারও বন্ধ থাকবে ন’টি মেট্রো স্টেশন। প্রশ্ন হল, আন্দোলন জারি থাকলে এই ভাবে কি তা সামাল দেওয়া যাবে? তা না হলে আর কী ভাবে আটকানো যাবে নামহীন, নেতৃত্বহীন এই জনস্রোত?
উত্তর জানে না কেউ। |
|
|
|
|
|