সাধারণ মানুষের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা হঠাৎই বেড়ে উঠেছে। তার কারণ ইতিমধ্যেই ভর্তুকির টাকা সরাসরি প্রাপকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
এই ভর্তুকির প্রাপক ছোট শহর এবং গ্রামের অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী (বি পি এল গোষ্ঠীর) মানুষ প্রত্যেকের থাকতে হবে একটি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। প্রথম দিকে শিক্ষা, খাদ্য এবং জ্বালানি বাবদ ভর্তুকির টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের ধারণা, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ভর্তুকি নিয়ে রাজনীতি কমবে, মাঝপথে টাকা লোপাট হয়ে যাবে না, লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকবে না, কাউকে ধরাধরি করতে হবে না, টাকা সরাসরি অতি দ্রুত পৌঁছে যাবে প্রকৃত প্রাপকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
গ্রামাঞ্চলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে এমন মানুষের সংখ্যা বেশ কম। সরকার চাইছে, প্রত্যেক পরিবারে অন্ততপক্ষে একটি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকুক এবং তা পরিবারের কর্তার নামে থাকলেই ভাল হয়। যে- সব গ্রামে দু’হাজার বা তার বেশি মানুষের বসবাস, সেখানে একটি করে ছোট ব্যাঙ্ক খোলার পরিকল্পনা সরকার হাতে নিয়েছে। এ ব্যাপারে কথা চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে। বড় এবং মাঝারি শহরে সমস্যা ততটা নেই, কারণ শহরের বেশির ভাগ মানুষেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে।
সরকার চাইছে, দ্রুত এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দিতে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাঙ্কগুলি এবং জেলা ও ব্লক স্তরে প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতা। ২০১৪-র নির্বাচনের আগেই এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে সরকারেরও বড় ফায়দা হবে। ইউপিএ-র শরিক দলগুলির লাভ হবে ঘরে ঘরে ভর্তুকির টাকা পৌঁছে দিতে পারলে। এই কারণে সরকার গুরুত্ব সহকারে কাজ শুরু করতে চায় নতুন বছরের গোড়া থেকেই। একই ভাবে ২০০৯-এর নির্বাচনের আগে চালু করা হয়েছিল ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম।
ভর্তুকির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার শর্তও হবে অপেক্ষাকৃত সহজ। লাগবে শুধু সচিত্র পরিচয়পত্র যেমন ভোটার আইডি কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি। ভর্তুকির টাকা সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে ব্রাজিল এবং রাশিয়া সাফল্য পেলেও তেমন সাফল্য আসেনি আফ্রিকার কোনও কোনও দেশে। ভারতের সমস্যা এদের তুলনায় অনেক বেশি। এই বিশাল জনসংখ্যার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলানো মোটেই সহজ কাজ নয়। এক দিকে যেমন অভাব আর্থিক সাক্ষরতার, অন্য দিকে গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিকাঠামোও অপ্রতুল। দ্রুত এই ঘাটতি মেটানোও সম্ভব নয়। অর্থাৎ, কত তাড়াতাড়ি সরকারের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকছে ।
প্রথমে প্রত্যক্ষ সুবিধা স্থানান্তর প্রকল্প (ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার স্কিম) চালু করা হবে দেশের ৪৩টি জেলায়। এই জেলাগুলিতে আধার কার্ড ইস্যুর কাজ এখনও অনেক বাকি। এই কার্ডের ভিত্তিতেই খোলা হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এ ধরনের ‘নো ফ্রিল’ অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা বাধ্যতামূলক ভাবে জমা রাখার প্রয়োজন নেই (জিরো ব্যালান্স)। কত দ্রুত আধার কার্ড ইস্যু এবং ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার কাজ সম্পন্ন হয়, তাই এখন দেখার।
বহু সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা মানুষের মধ্যে আর্থিক সাক্ষরতার প্রসারে কাজ করছে। এ ব্যাপারে খরচ করা হচ্ছে ‘ইনভেস্টর্স এডুকেশন অ্যান্ড প্রোটেকশন ফান্ড’-এর টাকা। উদ্যোগী কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রক, মুম্বই এবং ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ, চার্টার্ড, কস্ট এবং কোম্পানি সেক্রেটারি ইনস্টিটিউট ও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। আর্থিক সাক্ষরতা প্রসারে গুরুত্ব আরোপ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। গ্রামাঞ্চলে এই ব্যাপারে মানুষের জ্ঞান কম থাকায় মোটা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কষ্টের টাকা করায়ত্ত করছে বেশ কিছু ভুঁইফোঁড় অর্থ লগ্নি সংস্থা তাঁরা টাকা ফেরত পাবেন কি না কোনও নিশ্চয়তা নেই। এত টাকা এরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করছে যে, ডাকঘর তো বটেই, ব্যাঙ্কেও জমার পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। মানুষের অর্থ সংক্রান্ত জ্ঞান বাড়লে এই ভাবে অর্থ সংগ্রহ এত সহজ হবে না। এই কারণেই কলকাতার মতো বড় শহরে আমানত সংগ্রহকারী এই সংস্থাগুলি তেমন পাখা মেলতে পারেনি। কারণ একটাই। এখানকার আর্থিক সাক্ষর মানুষ এদের প্রতিশ্রুতিতে না-ভুলে পাল্টা প্রশ্ন করতে জানেন এবং এঁদের অনেক প্রশ্নেরই সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারবে না এই সংস্থাগুলি। |