এত দিন যিনি ছিলেন রাজা, আজ তিনি ফকির।
এক বছর আগেও ক্রিকেটবিশ্ব চলত যাঁর অঙ্গুলিহেলনে, এই পুণে থেকে কয়েকশো মাইল দূরে যিনি ২ এপ্রিলের আতসবাজি-ভরা রাতে একদিনের ক্রিকেটে বাকি বিশ্বকে পদানত করেছিলেন, দেশকে যিনি দিয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের এক নম্বরের গর্বের জার্সি, আজ তিনিই লাঞ্ছিত। তাঁর গর্বের মুকুট আজ মাটিতে লুটোচ্ছে। তাঁর নিজের দেশের মাটিতেই।
তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি আজ অস্তিত্বসঙ্কটে। যাঁর ‘চওড়া কপাল’ ক্রিকেটবিশ্বের প্রবাদ-বইয়ে বড়সড় জায়গা করে নিয়েছে, তাঁর সামনেই আজ জীবনের চরম অগ্নিপরীক্ষা।
টেস্ট গিয়েছে। সামনে পড়ে এখন সীমিত ওভারের দুনিয়া। আরও ভাল করে বললে, ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ। টি-টোয়েন্টি। যেখানে পাঁচ দিন সেশন ধরে-ধরে স্ট্র্যাটেজি বদলানো নেই। প্ল্যান ‘এ’ কাজে না লাগলে নেই প্ল্যান ‘বি’ বা ‘সি’ বের করার ঝঞ্ঝাট। এ স্রেফ সাড়ে তিন ঘণ্টার যুদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে যে যুদ্ধে অধিনায়কের মস্তিষ্কপ্রয়োগের বিশেষ দরকার পড়ে না। লাগে শুধু ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের ঠিকঠাক কথা বলা। ধোনি নিজেই তো বলে গেলেন, “কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে বিশ্লেষণের জায়গা নেই। শুধু খেলাটা উপভোগ করতে হয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ রান বাঁচানো। একটা রান আউট। একটা ভাল ক্যাচ। ছোট ছোট জিনিসগুলো উপভোগ করা।”
এ বার পারবেন ধোনি? |
• কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে বিশ্লেষণের জায়গা নেই। শুধু খেলাটা উপভোগ করতে হয়।
• নাগপুরে তো আমরা ভালই খেলেছি। কিন্তু পিচে বোলারদের জন্য কিছু ছিল না।
• অতীত নিয়ে বেশি ভাবা উচিত নয়। তাই এখন টেস্ট নয়, টি-টোয়েন্টি নিয়েই ভাবছি।
• ভারতীয় ক্রিকেটে তো একটা কিছু হলেই প্রচুর সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। নানা বিষয়ে কাটাছেঁড়া চলে। |
|
|
পশ্চিমঘাটের কোলে সুব্রত রায় সহারা স্টেডিয়ামে বুধবার যে ধোনিকে দেখা গেল, তাঁকে দেখে কে বলবে এই মানুষটার গর্দান নেওয়ার জন্য গর্জে উঠেছে ভারতীয় ক্রিকেট অণুবিশ্ব। কে বলবে, তিনটে টেস্টের ব্যবধানে ভারতীয় ক্রিকেটের নয়নের মণিই এখন সাইক্লোনের কেন্দ্রবিন্দু? চুলে হয়তো এই ক’দিনে একটু বেশিই পাক ধরেছে। একপেশে হাসিটাও আজ অত ঝলমলে নয়। তবু ইনি ক্যাপ্টেন কুল-ই। না হলে দেশের মাঠে আট বছর পরে টেস্ট সিরিজ খোয়ানোর জ্বালা আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যেই জুড়িয়ে যায়? সাংবাদিক সম্মেলনে এসে ঠাট্টা করতে পারেন ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে? এত কিছুর পরেও বলতে পারেন, ক্রিকেটটাকে উপভোগ করতে হবে?
যে নাগপুর টেস্টে ধোনির নেতৃত্ব দেখে বিরক্তিতে সরব হয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো প্রাক্তনরা, সেই টেস্ট নিয়ে ধোনির ব্যাখ্যা, “নাগপুরে তো আমরা ভালই খেলেছি। কিন্তু ওখানকার পিচে বোলারদের জন্য কিছু ছিল না।” অপ্রত্যাশিত টেস্ট সিরিজ হারের ময়নাতদন্ত নয়, তাঁর কথায় উঠে আসে পূজারা-কোহলিদের প্রশংসা। ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ভারতেও তিন ধরনের ক্রিকেটে তিন জন অধিনায়ক থাকলে ভাল হয় কিনা জানতে চাইলে বেরিয়ে আসে চেনা ঔদ্ধত্য। “এ রকম গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের আগে এটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। ভারতীয় ক্রিকেটে তো একটা কিছু হলেই প্রচুর সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন, সিনিয়র, জুনিয়র নানা বিষয় নিয়ে কাটাছেঁড়া চলে। সব কিছুর উত্তর দিতে দিতে তো সময় শেষ হয়ে যাবে!” যার পরপরই ধোনি অনায়াসে বলে দেন, “অতীত নিয়ে বেশি ভাবা উচিত নয়। তা সে অতীত ভালই হোক বা খারাপ। আমি সব সময় বিশ্বাস করি, বর্তমানে থাকতে হবে। এটা একেবারে আলাদা ফর্ম্যাট। টেস্টে কী হয়েছে না হয়েছে, সেগুলো এখানে নিয়ে আসার কোনও মানে নেই। তাই এখন টেস্ট নয়, টি-টোয়েন্টি নিয়েই ভাবা যাক।”
ভাবতে তো চাইবেনই। এ তো আর টেস্ট-পৃথিবীর গোলকধাঁধা নয়। এটা তাঁর একান্ত আপন সীমিত ওভারের বিশ্ব। এখানে আইনকানুন তিনি তৈরি করেন, তিনিই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আর আগামী দুটো ম্যাচের কথা ভাবলে তাঁর খুশি হওয়ারই কথা। যে ইংল্যান্ডের কাছে টেস্টে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে, সেই টিমের সঙ্গে এই ইংরেজ দলের মিল প্রায় নেই বললেই চলে। দেশে ফিরে গিয়েছেন অ্যালিস্টার কুক, কেভিন পিটারসেন, জেমস অ্যান্ডারসন, মন্টি পানেসররা। আহত স্টুয়ার্ট ব্রডের জায়গায় তরুণ, অখ্যাত ইংল্যান্ড টি-টোয়েন্টি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইয়ন মর্গ্যান। আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেললে কী হবে, পুণের মাঠে এই প্রথম পা রাখলেন তিনি।
বিপক্ষে প্রায়-আনকোরা এগারো জন ক্রিকেটার। পাটা উইকেট, যেখানে এই মরসুমেরই দুটো রঞ্জি ম্যাচ মিলিয়ে বারোশোর উপর রান উঠেছে। ছোট আউটফিল্ড। সামনের চারটে টি-টোয়েন্টি জিততে পারলে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হওয়ার হাতছানি। টেস্ট সিরিজ ভরাডুবিকে আরও অতীতে ঠেলে দেওয়ার সব মশলা মজুত।
শুধু কপালটা সঙ্গে থাকলে হয় ধোনির! |