‘দ্য আর্ট অফ ওয়ার’-এ সান সু বলেছেন, জয়ের অনুঘটকযা উনি আশা করেছিলেন চিনের সঙ্গে থাকবেএকটা অপ্রতিরোধ্য মানসিক উচ্চতার প্রভাব ফেলবে। যুদ্ধে নামার আগেই। তার পর যখন জয় আসবে, তখন মনে হবে সেটা পাহাড়ের গা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ার মতোই অনিবার্য, অপ্রতিরোধ্য। ভারতের মাটিতে চার টেস্টের সিরিজে অ্যালিস্টার কুকের নেতৃত্বে ইংরেজ ক্রিকেট দল ওই মানসিক উচ্চতার পরিচয় দিয়েছে। চিড়-ধরা, দ্বিধাগ্রস্ত ভারতীয় দলের সামনে ইংল্যান্ডের জয় অনিবার্য দেখিয়েছে।
সিরিজের শুরুতে যদিও মনে হচ্ছিল মানসিক শ্রেষ্ঠত্বটা ভারতেরই সঙ্গী। আমদাবাদে ইংল্যান্ডকে ধসিয়ে দিয়েছিল বীরেন্দ্র সহবাগের ৯০ বলের সেঞ্চুরি, চেতেশ্বর পূজারার ডাবল সেঞ্চুরি আর প্রজ্ঞান ওঝার নেতৃত্বে হোম টিমের স্পিনাররা। ভেবে দেখুন ইংল্যান্ডের প্রত্যাবর্তন কী অসাধারণ! আমি বলব এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক ছিল আমদাবাদে, যখন ইংল্যান্ড ৩৩০ রানে পিছিয়ে ফলো অন করছিল। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ওঝার তিন নম্বর ওভারে মিড-উইকেটের ওপর দিয়ে ওকে স্লগ-সুইপ করেছিল কুক। সেঞ্চুরি করার রাস্তায় যে দৃশ্যটা বেশ কয়েকবার দেখা গেল। ইংল্যান্ডের ন’উইকেটে হার কুক আটকাতে পারেনি। কিন্তু ওঝার বিরুদ্ধে ওর স্লগ-সুইপ আর পুল-ড্রাইভঅনেক সময়ই যার আগে কুক ক্রিজ থেকে দু’এক পা বেরিয়ে এসেছিলদুটো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয়। এক, এশিয়ায় অতীতের ইংল্যান্ড টিমের মতো কুকের ইংল্যান্ড লড়াই না করে হার মানবে না। আর দুই, ওঝার ফাঁস ছিঁড়ে বেরনোর দায়িত্বটা কুকই প্রথম নেবে। সিরিজের আগেই লিখেছিলাম, জিততে হলে ইংল্যান্ডকে ওঝার নাগপাশ ভাঙতে হবে। |
মুম্বইয়েও মাঝেমধ্যে ওঝাকে আক্রমণ করছিল কুক। কিন্তু অন্য দিক থেকে সাহায্য করার মতো কাউকে ওর দরকার ছিল। আর এই সময়েই প্রবেশ কেভিন পিটারসেনের। আর ওর কেরিয়ারের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত টেস্ট সেঞ্চুরির। পিটারসেনের ১৮৬ নিশ্চয়ই ভারতীয় বোলারদের বাকি সিরিজে হীনমন্যতায় ভুগিয়েছে। দেখুন না, আমদাবাদে কুড়িটা উইকেট নেওয়ার পরের তিনটে টেস্টে ওরা মাত্র দশ, তেরো আর চোদ্দোটা উইকেট তুলতে পেরেছে।
ভারতীয় বোলিংয়ের এই ব্যর্থতা ওদের ব্যাটিংয়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছিল। যে চাপ ব্যাটসম্যানরা নিতে পারেনি। সিরিজের আগে যখন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কেরিয়ারগ্রাফ নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, তখন মনে হয়েছিল ওদের দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। পূজারা আর বিরাট কোহলির রেখচিত্র ছিল ঊর্ধ্বগামী। কিন্তু ওরা কেউই দশটা টেস্ট খেলেনি, তাই ওদের কাছ থেকে ধারাবাহিকতা আশা করা ঠিক হত না। অন্য দিকে সহবাগ, গম্ভীর আর সচিন তেন্ডুলকরের কেরিয়ারের রেখচিত্র ছিল নিম্নগামী। তিনজনই গত দু’বছর রানের খরার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
প্রথম টেস্টের পরে সহবাগ আত্মতুষ্ট হয়ে পড়ে? একটা বড় ইনিংস খেলেই থিতিয়ে পড়াভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কি এই ধারাটা আছে? জানি না। কিন্তু এটা জানি যে, মুম্বইয়ের ঈশ্বরদত্ত ইনিংসের পরে কলকাতা আর নাগপুরদুটো টেস্টেই পিটারসেন হাফসেঞ্চুরি করল। নিজের সেরা ফর্মের ধারেকাছে না থাকলেও জরুরি রানগুলো তো করে দিল। আমদাবাদে প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পরে সহবাগ আর একটা হাফসেঞ্চুরিও করেনি।
দুই গ্রেট স্ট্রোকপ্লেয়ারের ফিল্ডিংও তুলনা করে দেখা যাক। ফিল্ডিং করার সময় পিটারসেন সারাক্ষণ চনমনে, দায়বদ্ধ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বলেই কি? সহবাগের মধ্যে এই ব্যাপারগুলো একটু কম চোখে পড়ল। নাগপুরে এক দিন লাঞ্চের পরে লেগসাইড দিয়ে দুই লেগ-বাইয়ের জন্য বল যাচ্ছিল। লেগ-স্লিপে দাঁড়ানো সহবাগ পেছন ফিরে বলটার পিছনে জগিং করছিল। তার চেয়ে একটুও দ্রুত নয়। ভারতের একমাত্র পেসার হিসেবে বল করে করে ক্লান্ত ইশান্ত শর্মা শেষ পর্যন্ত স্কোয়্যার লেগ থেকে দৌড়ে বলটা ধরল। যদিও ও বলটার থেকে সহবাগের চেয়ে অনেক দূরে ছিল। এ ভাবেই ফিল্ডিং করার সময় ভারতকে দিগভ্রান্ত দেখিয়েছে। |
ভারত যেখানে অন্ধকারে |
|
সহবাগ: প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরির পর ঝিমিয়ে যাওয়া। ফিল্ডিংয়েও। বাকি সিরিজে একটা হাফ সেঞ্চুরিও নেই। ফিল্ডিংয়েও বল ধরতে ‘জগিং’ করেছে।
সচিন: শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে আস্তে আসা লেগ গ্লান্সও ঝাঁপিয়ে ধরতে ব্যর্থ। আগেকার দিনে ফিল্ডিং করার ক্ষমতা না থাকলে অবসর নিয়ে নিত ক্রিকেটাররা।
জাহির-ইশান্ত পেস জুটি: টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে ভারতের এক নম্বরে ওঠার প্রধান কারণ ছিল জাহির-ইশান্তের নতুন বলে দ্রুত উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা। এই সিরিজে যা দেখাই যায়নি।
ওঝা-অশ্বিন স্পিন জুটি: পিচের চাহিদা অনুযায়ী বলের গতি এবং ফ্লাইটের হেরফের কোনওটাই করাতে পারেনি দুই স্পিনার। |
|
|
গ্রেম সোয়ান আর জেমস অ্যান্ডারসনের সঙ্গে ইংল্যান্ড বোলিং আক্রমণে মন্টি পানেসর আসার পরে ওদের নির্দয়, নিখুঁত বোলিং তেন্ডুলকরের গলা টিপে ধরেছিল। ওর চেয়ে মন্থর আর বেশি ফ্লাইট করানো ওঝার চেয়ে ভাল বল করল পানেসর। পিচের সঙ্গে নিজের গতি মানিয়ে নিয়ে অশ্বিনকে টেক্কা দিয়ে গেল সোয়ান। আর ধোনি যে বলল, দু’দলের মধ্যে তফাত গড়ে দিয়েছিল অ্যান্ডারসনমোটেও ভুল বলেনি। ভারতীয় পেসাররা সব মিলিয়ে যে ক’টা উইকেট নিয়েছে (১২), অ্যান্ডারসনের একার নামের পাশেই ততগুলো শিকার।
এটাই হয়তো সমস্যার কেন্দ্রস্থল। সান সু হয়তো বলতেন যুদ্ধজয়ের জন্য যেমন সৈনিক দরকার, সে রকমই টেস্ট সিরিজ জেতার জন্য চাই পেসার। টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে যে ভারত এক নম্বরে উঠেছিল, তার কারণ কিছুটা ওদের দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইন-আপ আর কিছুটা ওদের অসাধারণ স্পিনার। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হল জাহির খান আর ইশান্ত শর্মার তীক্ষ্ম ওপেনিং পেস জুটি। বিপক্ষের দু’একটা উইকেট তাড়াতাড়ি পড়ে গেলে আসত অনিল কুম্বলে আর হরভজন সিংহ। ক্লোজ-ইন ফিল্ডার রেখে ব্যাটসম্যানদের ফোকাস নড়িয়ে দিত। এই সিরিজে ওঝা আর অশ্বিন যখন বল করতে এল তখন কুক আর নিক কম্পটন সেট হয়ে গিয়েছে। তখন তো খেলাটাই পাল্টে গিয়েছে।
ইতিহাসের দিকে একবার চোখ বোলালে ভাল হয়। টেস্ট ক্রিকেটের প্রাথমিক ইন্ধনটা জোগায় পেসাররাই। কিন্তু ভারতীয় পেসারদের মধ্যে মাত্র ছ’জন একশোটা টেস্ট উইকেট নিয়েছে। নাকি সাড়ে পাঁচ বলব? কারসন ঘাউড়ি মাঝে মাঝে স্পিন বল করত। বাকি পাঁচজন হল কপিল দেব, শ্রীনাথ, ইরফান পাঠান, জাহির খান আর ইশান্ত। আর ভবিষ্যতেও যদি এই সিরিজের মতো স্লো পিচ বানানো হয়, তা হলে কেউ কেন জোরে বল করতে চাইবে?
সিরিজের শেষে তেন্ডুলকরকে মাঠে দেখে খারাপ লাগছিল। নাগপুরে শেষ দিন কাঁধের চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যাওয়ায় বোধহয় ভালই হল। কোনও এক স্পিনারের জন্য যখন সচিন শর্ট ফাইন-লেগে ফিল্ডিং করছিল, তখন একটা লেগ-গ্লান্স ওর দিকে এসেছিল। টাইমিংটা ভাল হলেও বলটা খুব জোরে আসছিল না। সচিন ডান দিকে বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর বলটা বাউন্ডারির দিকে চলে গেল। ততক্ষণে প্রেসবক্সে বসা প্রায় সবাই লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল।
আগেকার দিনে যখন ক্রিকেটাররা অপেশাদার ছিল, তখন ফিল্ডিং করার ক্ষমতা না থাকলে ওরা খেলা ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন খেলাটার সঙ্গে এত টাকা জড়িয়ে গিয়েছে। আর স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস তো এই সে দিনই বলেছেন, “অবসর নেওয়ার পরে মনে হয় যেন তুমি আর বেঁচে নেই।” সচিন সব সময় সংখ্যায় বিশ্বাস করে এসেছে। যার শুরু ওয়ান ডে জার্সির ১০ নম্বর দিয়ে। ও কি চায় ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দুশো টেস্ট খেলা পর্যন্ত ক্রিকেটে থাকতে? ঠিক যে ভাবে ওয়ান ডে-তে ও-ই প্রথম দুশো করেছিল? দুশো টেস্টের মাইলফলক থেকে সচিন আর ছ’টা টেস্ট দূরে।
ফিল্ডিংয়ে যখন সহবাগ, সচিন আর জাহির আছে, তখন তো ভারতের তুলনায় ইংরেজ ফিল্ডারদের বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ লাগবেই। ফিল্ডিং সব সময়ই একটা দলের মানসিক অবস্থানের নির্ভরযোগ্য সূচক। ধোনির সমালোচনা হচ্ছে বটে, কিন্তু ওর আর কী-ই বা করার ছিল? কিপিং গ্লাভস খুলে বল করতে আসা? লর্ডসে যেটা করেছিল? নাকি দলকে তাতানোর জন্য কভারে ফিল্ডিং করা? ভারতীয় নির্বাচকেরা কিন্তু ধোনিকে দিয়ে এটাই করাবেন ভেবেছিলেন। কিপিং গ্লাভস ঋদ্ধিমান সাহাকে দিয়ে।
একজন উইকেটকিপার টেস্ট অধিনায়ক হলে তার সীমাবদ্ধতা কী কী, এই সিরিজে দেখা গেল। কুড়ি বা পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে যে সব ফিল্ডারই সারাক্ষণ তেতে থাকবে, সেটা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু পাঁচ দিনের টেস্টে, বিশেষ করে এখনকার ঠাসা ক্রিকেটসূচির মধ্যে, অধিনায়কের নিজেকে গোটা মাঠ ঘুরে টিমের সবার কাছ থেকে তাদের সেরাটা বের করে আনতে হবে।
তবে চিন্তা করবেন না। সান সু-র দর্শন যে কোনও দেশই ব্যবহার করতে পারে। ইংল্যান্ড এই সিরিজে ভারতের সঙ্গে যা করল, দু’বছর আগে অ্যাসেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গেও এক জিনিস করেছিল। গত গ্রীষ্মের সফরে আবার ইংল্যান্ডের সঙ্গে সেটাই করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পিটারসেনের এসএমএস আর অ্যান্ড্রু স্ট্রসের ভবিষ্যৎ ঘিরে ইংল্যান্ড টিমে যে ফাটল ধরেছিল, সেটাকে কাজে লাগিয়ে টেস্ট সিংহাসন থেকে ইংরেজদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।
আমাদের ভাগ্য ভাল, চিন এখনও টেস্ট ক্রিকেট খেলে না! |