সামনে ছাত্র। দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন অশীতিপর শিক্ষক। এগিয়ে গিয়ে তাঁর পা ছুঁলেন ছাত্র। মঞ্চের উপর যখন গুরু-শিষ্য, নীচে দর্শকাসনে তখন প্রশাসনের কর্তা থেকে কলেজের বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা। ছিলেন কয়েক জন সহপাঠীও।
বুধবার সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে সংবর্ধনা নিতে এসে এ ভাবেই বারবার আবেগ ছুঁয়ে গেল রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। মঞ্চের উপরে তাঁর সময়কার একমাত্র অধ্যাপক দেবরঞ্জন মুখোপাধ্যায়কে দেখে খুশি চাপতে পারেননি প্রণববাবু। মঞ্চেই ছিলেন তাঁর সহপাঠী প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। দুই বন্ধুর হাসি বিনিময় হল। টেবিলে রাখা ছিল কলেজ পত্রিকা। পাতা ওল্টালেন। কলেজের ছবির অ্যালবাম দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। পাশে বসে থাকা রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে কয়েকটি ছবি দেখালেন। |
১৯৫২ সাল থেকে চার বছর এই কলেজে আইএসসি এবং বিএ পড়াশোনা করেন কীর্ণাহারের এই ভূমিপুত্র। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রথম বার নিজের কলেজে এসে বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন তিনি। প্রণববাবু বলেন, “পুরনো কলেজে এলেই নস্টালজিক মানসিকতা গড়ে ওঠে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। এখানকার চার বছরের ছাত্রজীবনে আমার মার্কশিট খুব ভাল ছিল না। এরা সব আমার মার্কশিট বের করেছে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নম্বর কম ছিল। পরে অবশ্য সেটা বেড়েছে। তবে কলেজে আমাদের সময়ে বেশ কয়েক জন ভাল ছাত্র ছিল।” পাশে থাকা অমলবাবুকে দেখিয়ে বলেন, “এই অমল মুখোপাধ্যায়-- সেই সময় রাজ্যে পঞ্চম হয়েছিল।” মুচকি হাসি রাষ্ট্রপতির মুখে।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে বক্তৃতা দিতে উঠে বারবার তিনি স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন। ছাত্রজীবনের টুকরো টুকরো নানা ঘটনার কথা তাঁর মনে ভিড় করে। বলে চলেন তিনি, “আমরা যখন এখানে পড়তাম, তখন একটা চালাঘর ছাড়া কলেজে আর কয়েকটা মাত্র ঘর ছিল। তবে ছাত্রাবাস ছিল। আমি ছাত্রাবাসে থেকেই পড়াশোনা করেছি। ছেলেবেলায় কীর্ণাহার হাইস্কুলে পড়ার সময় ১০ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতাম। কষ্টও হত। মনে মনে চাইতাম, এমন জায়গায় পড়ব, যেখানে কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা থাকবে। সেটা এখানে আমি পেয়েছি।” তিনি জানান, কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় এক বার তিনি প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর দাদা অবশ্য অনেক বার ওই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। দর্শকাসনে বসে থাকা প্রণববাবুর দাদা পীযূষ মুখোপাধ্যায়ের মুখে এক চিলতে হাসি।
জীবনের বাকি পথ চলার মন্ত্রও এই কলেজ থেকেই পেয়েছিলেন সফল রাজনীতিক থেকে রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠা প্রণববাবু। তাঁর কথায়, “এই কলেজে এখনও লেখা রয়েছে, ‘জ্ঞান, ত্যাগ, সেবা’। ওই মন্ত্রই আমাদের উন্নত করেছে।” অমলবাবুও বলেন, “আমি প্রণববাবুর রাজনৈতিক জীবনও কাছ থেকে দেখেছি। রাজনীতি থেকে শুরু করে, এই যে রাষ্ট্রপতির পদ পর্যন্ত এসেছেন, তার মন্ত্র জুগিয়েছে এই কলেজ।” তাঁর সময়কার কলেজের দু’জন অধ্যাপকের কথা তিনি স্মরণ করেন। তাঁদের এক জন তাঁর সময়কার অধ্যক্ষ অরুণ সেন। প্রণববাবু বলেন, “অরুণবাবু সুন্দর ভাবে ইংরেজি পড়াতেন। এত সুন্দর তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল, আমি আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ও রকম বক্তা দেখিনি।” |
কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে এই প্রাক্তনী বলেন, “ওই টিনের চালাঘরের কথা, বটগাছটার কথা আমার মনে আছে। বটগাছের নিচে আমরা বসতাম। গল্প করতাম।” এর পর মুচকি হেসে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমরা তো একটু রোমান্টিক ছিলাম।” অমলবাবুর ইচ্ছা ছিল, কলেজ চত্বরে তৈরি হওয়া মঞ্চে ওঠার আগে প্রণববাবুকে ওই বটগাছটার কাছে নিয়ে যাবেন। কিন্তু নিরাপত্তার কড়াকড়িতে তা আর হয়ে ওঠেনি। কলেজ ছাড়ার আগে রাষ্ট্রপতি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, “দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পরিকাঠামোর অগ্রগতি হলেও গবেষণাক্ষেত্রটির দুর্বলতা রয়েছে। গবেষণার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে না।” দেবরঞ্জনবাবু বলেন, “অধ্যক্ষকে বলছি, তাঁর ঘরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ছবি যেন টাঙানো থাকে। রাজ্যের মধ্যে এই কলেজ থেকেই রাষ্ট্রপতি পাওয়া গিয়েছে।” এক ঘণ্টার সফর শেষে অধ্যক্ষের ঘরে সহপাঠী ও কলেজ পরিচালন সমিতির সঙ্গে প্রণববাবুর চা চক্রে যোগ দেন। |