পঞ্চায়েতে অন্য এক পরিবর্তন,
অস্বস্তিতে সব দলই
ঞ্চায়েত নির্বাচনে যে দলই জিতুক, হারবে পুরুষতন্ত্র, বদলাবে উচ্চবর্ণের আধিপত্যের নকশা। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের আসন সংরক্ষণের তালিকা হাতে আসার পর জেলায় জেলায় এমনই সম্ভাবনার মুখে পড়েছে সব দল। দেখা যাচ্ছে, কার্যত তিন-চতুর্থাংশ আসনে রয়েছে মহিলা, ওবিসি, দলিত বা জনজাতির জন্য সংরক্ষণ। কংগ্রেসের এক নেতা বলেই ফেলছেন, “এ তো পাগলের প্রলাপ!” তবে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর মতে, যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে অন্যান্য রাজ্যে নিম্নবর্ণরাই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে এ বার তার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। “মমতার কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে নানা কথা হয়, কিন্তু পঞ্চায়েতে বাড়তি সংরক্ষণ বলবৎ করে তিনি জরুরি কাজ করেছেন,” বলেন তিনি।
এত দিন ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ছিল ৩৩%, দলিত-আদিবাসীরা সংরক্ষিত আসন পেতেন জনসংখ্যা অনুপাতে। অথচ নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বাদে প্রায় সব দলেরই নেতা-কর্মীদের বড় অংশ সংরক্ষিত গোষ্ঠীগুলির বাইরে পড়েন। তাঁরা সংখ্যাধিক্যের জোরে মহিলা, দলিত-আদিবাসী জনপ্রতিনিধিদের কার্যত ‘রাবার স্ট্যাম্প’ করে রেখেছেন, এমন অভিযোগ উঠেছে বরাবরই। জাতীয় তফসিলি জাতি কমিশনের চেয়ারম্যান পান্নালাল পুনিয়ার মতে, “মহিলা বা নিম্নবর্গের মানুষকে পঞ্চায়েতে সংরক্ষণ দেওয়া হলেও পিছন থেকে পুরুষ বা উচ্চবর্ণের লোকেরাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন।”
সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাটের অবশ্য দাবি, পশ্চিমবঙ্গের চেহারাটা আলাদা। হরিয়ানায় কোনও দলিত মহিলা গ্রামপ্রধান হলেও তাঁকে উচ্চবর্ণের লোকেদের সামনে মাটিতে বসতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে তা হয় না।
কিন্তু এ রাজ্যেও দেখা যাচ্ছে, জেলা পরিষদগুলিতে পূর্ত কর্মাধ্যক্ষের মতো দায়িত্বপূর্ণ পদ মহিলাদের কখনওই দেয়নি কোনও রাজনৈতিক দল। মহিলা-শিশুকল্যাণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো বিষয়ের গণ্ডিতে রাখা হয়েছে তাঁদের। দলেও রাখা হয়েছে বাইরের বৃত্তে, গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক দায়িত্ব মিলেছে খুব কম। তৃণমূলের একজনই জেলা সভাপতি মহিলা, তিনি সাবিত্রী মিত্র। মন্ত্রিসভায় তাঁর দফতর ‘মহিলা ও শিশুকল্যাণ।’
সিপিএমের জেলা কমিটির সম্পাদক পদে কোনও মহিলা বা আদিবাসীর প্রতিনিধি নেই। আশিস নন্দী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে সব সময়ে প্রচার করা হয়েছে যে এখানে শ্রেণিভেদ রয়েছে, জাতিভেদ নেই। তাই এখানে জাতিভেদ সবচেয়ে জোরালো, দলিতরা কোণঠাসা।”
গড়পড়তা ৭৫ শতাংশ প্রতিনিধির আসনে মহিলা-নিম্নবর্ণরা ভোটে জিতে এলে আর কি প্রান্তবাসী করে রাখা যাবে তাঁদের? নারী আন্দোলনের নেত্রী শাশ্বতী ঘোষের মতে, সংখ্যাধিক্যের জোরে প্রভাব খাটানোর সুযোগ এ বার কমবে। “এখন তো মেয়েদের শুধু নারী ও শিশুকল্যাণে নেওয়া চলবে না, অন্য দায়িত্বেও নিতে হবে। নইলে কাজ করার লোক পাওয়া যাবে না।”
এত দিনও যে মেয়েরা কেবল স্বামী-শ্বশুর, বাবা-দাদার মুখপাত্র হয়ে ছিলেন, এমন কিন্তু নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বলেন, “সংরক্ষিত আসনের জনপ্রতিনিধিরা বেশি দিন ‘প্রক্সি’ থাকেন না, ক্রমশ স্বকীয় ভাবে কাজ করতে শুরু করেন।” এর প্রমাণ মিলেছে গবেষণাও। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতা-র শিক্ষক রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীদের একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, পশ্চিমবঙ্গ ও রাজস্থানে মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানরা তাঁদের চাহিদার বিষয়গুলিতে (যেমন পানীয় জল, শিশুশিক্ষা) পয়সা বরাদ্দ করেন পুরুষদের চাইতে বেশি।
জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাঁরা মহিলাদের ‘যোগ্যতা’ নিয়ে চিন্তিত। সিপিএমের বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্রের মতে, “যোগ্য মহিলারা নির্বাচিত না হলে পঞ্চায়েতের সুফল পাওয়া মুশকিল।” উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদে কংগ্রেসের দলনেতা পূর্ণেন্দু দে-র আশঙ্কা, “প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বেগ পেতে হবে।” উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেস সভাপতি দেবী ঘোষাল তিক্ত কণ্ঠে বলেন, “এগুলি পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে যাব।”
উল্টো স্বরও অবশ্য শোনা যাচ্ছে। জলপাইগুড়ির সিপিএম নেত্রী মিনতি সেন বা তৃণমূলের জেলা সভাপতি চন্দন ভৌমিক মনে করছেন, অঙ্গনওয়াড়ি বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত মহিলারা সচেতন ও সক্রিয়। তাই কোনও দলেরই যোগ্য প্রার্থী পেতে অসুবিধে হবে না। প্রাক্তন সাংসদ মিনতিদেবী জানান, সাংসদ হবার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া অভ্যাস করেছিলেন তিনি। শিখেছেন প্রশাসনিক কাজ। “নতুন প্রতিনিধিদেরও পৃথক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে,” বলেন তিনি।
গণতন্ত্রের ছয় দশক পার করেও যে বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হয়, তা-ই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দলগুলো মহিলা, নিম্নবর্ণ, জনজাতির মানুষদের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রেখেছে। শাশ্বতী ঘোষের মতে, “পার্টির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রের যোগ সব সময়েই গভীর। এ বার দলগুলো মেয়েদের রাজনীতির প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব না দিলে ‘বাহিরের’ পরিসরে তাদের কাজে লাগানো মুশকিল হবে।” অন্তত দলের নিচুতলায় মহিলা-নিম্নবর্ণের নেতৃত্বের জায়গা দিতে হবে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই পরিবর্তনের দোরগোড়ায় রাজ্যকে এনে দাঁড় করিয়েছে এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.