তাঁর হাতের জাদুতে বিশ্বের ভারত-দর্শন
শ্চিমী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আর রক মিউজিকের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরসেতু তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। রবিশঙ্করকে তাই বিটল্স-এর মূল গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন নির্দ্বিধায় বলতেন ‘গডফাদার অফ ওয়র্ল্ড মিউজিক’। রবিশঙ্কর নিজেও পশ্চিমের কাছে ভারতীয় সঙ্গীতের দরজা খুলে দেওয়াকেই তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মানতেন।
নৃত্যশিল্পী হিসেবে দাদা উদয় শঙ্করের ডান্স ট্রুপের সঙ্গে ১৯৩০-এর প্রথম দিকেই বিদেশের মাটিতে পা ফেলেছিলেন শিশু রবিশঙ্কর। অচিরেই আগ্রহ গড়ে ওঠে সেতারবাদনে। ১৯৩৭ সালে নাচ ছেড়ে আলাউদ্দিন খান-এর কাছে সেতার শিক্ষা শুরু। নিজের প্রথম রাগ সৃষ্টি ১৯৪৫-এ। পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকেই পশ্চিমে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন রবিশঙ্কর। তাঁর জনপ্রিয়তা ক্রমশ দেশের সীমানা ছাড়াতে শুরু করেছে।
১৯৫২-য় রবিশঙ্করের সাক্ষাৎ মার্কিন বেহালাবাদক ইহুদি মেনুহিনের সঙ্গে। এর পরেই দুই সুরস্রষ্টা তৈরি করবেন ‘ওয়েস্ট মিটস ইস্ট’ (১৯৬৭), ‘ওয়েস্ট মিটস ইস্ট, ভল্যুম টু’ (১৯৬৮) এবং ‘ইমপ্রোভাইজেশনস: ইস্ট মিটস ওয়েস্ট।’ প্রায় একই সময়ে ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজ স্যাক্সোফোন-বাজিয়ে জন কোলট্রেনের পরিচয় করিয়েছেন রবিশঙ্কর। কোলট্রেন নিজের ছেলের নাম রেখেছিলেন রবি।
তবে পশ্চিমী দুনিয়া রবিশঙ্করকে আরও বেশি করে চিনেছে বিটল্স-এর জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্যের পর্বে। ১৯৬৬-তে লন্ডনে দু’জনের প্রথম দেখা। “রবিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেননি। উল্টে আমিই প্রভাবিত হয়েছিলাম” প্রথম সাক্ষাতের পরে এমনটাই মনে হয়েছিল হ্যারিসনের। যে সাক্ষাৎ শুধু দু’জন বড় সঙ্গীতশিল্পীর বন্ধুত্বেরই সূচনা করেনি, ভারতীয় দর্শনের প্রতি হ্যারিসনের আগ্রহে অনুঘটকেরও কাজ করেছিল। যে কারণে জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া বলেন, “শুধু দু’টো মানুষের আলাপ নয়, ওঁদের মাধ্যমে দু’টো সংস্কৃতির আলাপ তৈরি হয়েছিল।”
সঙ্গীত, পার্থিব জগত ও আধ্যাত্মিকতা-সব দিক থেকেই রবির চলে যাওয়া এক বিশাল ক্ষতি।

প্রাক্তন বিটল্স সদস্য
‘নরউইজিয়ান উড’ গানটিতে হ্যারিসন পশ্চিমী সুরে বেঁধেছিলেন সেতারকে। কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছিল, হাতে-কলমে রবিশঙ্করের কাছে না শিখলে কিছুতেই পূর্ণতা আসছে না। অতঃপর শিক্ষা চলল ইংল্যান্ডে হ্যারিসনের বাড়িতেই। তার পর কিছু দিন দু’জনে চলে এলেন কাশ্মীরে। পরে আবার ক্যালিফোর্নিয়া। এর পরেই ‘রাবার সোল’, রিভলভার’ এবং ‘সার্জেন্ট পেপারস লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড’ বিটল্স-এর এই তিনটি অ্যালবামে ব্যবহার করা হল সেতার। তা থেকে অনুপ্রাণিত হল ‘দ্য রোলিং স্টোনস’, ‘দ্য অ্যানিমালস’-এর মতো ব্যান্ডও।
১৯৬৭ সালে মনটেরে আন্তর্জাতিক পপ উৎসবে টানা চার ঘণ্টা অসংখ্য শ্রোতার সামনে বাজাতে দেখা যায় রবিশঙ্করকে। ১৯৬৮ সালে উডস্টক উৎসবের প্রথম দিনেও ফের তাঁর সেতারের মূর্চ্ছনা। হ্যারিসনের উদ্যোগে ’৭১-এ বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থসংগ্রহে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠান। যেখানে রবিশঙ্করের সঙ্গে ছিলেন আল্লা রাখা এবং আলি আকবর খানও। রবিশঙ্কর তখন ভারতীয় সঙ্গীতের রকস্টার!
সন্তুরবাদক তরুণ ভট্টাচার্য পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রায় তিন দশকের ছাত্র। তাঁর মতে, সব ধরনের শ্রোতাকে সমান গুরুত্ব দিতেন পণ্ডিতজি। জানতেন, ভারতীয় রাগসঙ্গীত প্রথাগত ভাবে যে ভঙ্গিতে গাওয়া হয়, তত লম্বা সময় ধরে আলাপ শোনার ধৈর্য পশ্চিমী শ্রোতাদের নেই। তিনি একটা রাগ অল্প সময় ধরে বাজাতেন, জমাটি অংশ বাজাতেন, ঝালার কাজ করতেন।
অজয় চক্রবর্তী অবশ্য ভিন্নমত। তিনি বললেন, ‘‘সেতারবাদনে রবিশঙ্করের কৃতিত্ব খাটো না করেও বলতে হয়, রবিশঙ্কর একটি বিশেষ সময়ের ফসল। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁকে পশ্চিমে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করেছে। তাঁর আদবকায়দা, ইংরেজি আর ফরাসিতে স্বচ্ছন্দ হওয়া এগুলোও পশ্চিমে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করেছিল তাঁকে। এখানেই আলি আকবর খান তাঁর থেকে পিছিয়ে গেলেন।’’
সেতুবন্ধন। বিটল্স খ্যাত জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে রবিশঙ্কর।—ফাইল চিত্র
কিন্তু সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই পপ সঙ্গীত থেকে নিজেকে দূরে সরাতে শুরু করলেন শিল্পী। বাড়ালেন ধ্রুপদী শিল্পীদের সঙ্গে কাজের পরিমাণ। জার্মান পিয়ানোবাদক আন্দ্রে প্রেভিনের সঙ্গে বাজালেন। ১৯৭৮-এ হাত মেলালেন জাপানি সঙ্গীতের সঙ্গে। শাকুহাচি-শিল্পী (জাপানি বাঁশি) হোজান ইয়ামামোতো এবং কোতো-শিল্পী (জাপানি তারবাদ্য) সুসুমু মিয়াশিতার সঙ্গে রেকর্ড হল ‘ইস্ট গ্রিটস ইস্ট।’ কেন? ১৯৮৫-তে একটি সাক্ষাৎকারে রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “সমাজ তখন পাল্টাচ্ছিল। তার জন্য এক দিকে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতাম। যদিও হিপি আন্দোলনের কোনও সারবত্তা নেই বলে মনে হত। কিন্তু যারা আন্দোলন করছে, তাদের প্রাণশক্তি দেখার মতো ছিল। তবে মাদকের সঙ্গে সঙ্গীতকে জড়ানো একেবারেই মানতে পারতাম না।”
রক শিল্পীদের রংচঙে পোশাক, মার্কিন শিল্পী জিমি হেনড্রিক্সের গিটারে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ‘পাগলামি’ দেখে চমকে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। বলেছিলেন, “এটা বাড়াবাড়ি। আমাদের সংস্কৃতিতে বাদ্যযন্ত্রকে ঈশ্বরের অংশ বলে মনে করা হয়।” ভারতীয় সঙ্গীতের সেই ঐতিহ্য, গভীরতা এবং শৃঙ্খলার সংস্কৃতি থেকে নিজেকে বিচ্যুত হতে দেননি কখনওই। “আমার অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীদের ঠিক মতো বসিয়ে শোনার অভ্যেস তৈরি করার চেষ্টা করেছি। বুঝিয়েছি মাদক নয়, তূরীয় আনন্দ পেতে সঙ্গী হতে পারে সঙ্গীতই।”
তবুও পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে রবিশঙ্করের পরীক্ষানিরীক্ষা সনাতনপন্থী সঙ্গীত-অনুরাগীদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল। তিনি জানতেন সে কথা, “ভারতে আমাকে ধ্বংসাত্মক বলে মনে করা হত। সুরকার হিসেবে আমি সব কিছুতে আগ্রহী ছিলাম, ইলেকট্রনিক মিউজিক এবং আভাঁ গার্দেও। কিন্তু সেতারবাদক হিসেবে যা শিখেছি, প্রাণপণে তাকে রক্ষা করার চেষ্টাই করে গিয়েছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.