সম্পাদকীয় ১...
বাঙালি চলিল যুদ্ধে
বাঙালি চাঁদ-নদী-ফুল-তারা-পাখি লইয়া পদ্য রচনা করে, গীত গায়, সেরেস্তায় কেরানিগিরি করে, কিন্তু লড়াই করিতে জানে না বা চাহে নাএই অপবাদ লইয়া পরাধীন ভারতেও গ্লানির অন্ত ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো দেশপ্রেমিক কবিরা ‘একদা যাহার বিজয়সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়’ কিংবা প্রতাপাদিত্য সহ বারো ভুঁইয়ার মুঘলদ্রোহী লড়াই স্মরণ করিয়া বাঙালি যে মেষ নহে, মানুষ, তাহা সদর্পে উচ্চারণ করিয়াছিলেন। সপ্তদশ অশ্বারোহীর সামনে পলায়নপর বাঙালি সম্রাট লক্ষ্মণ সেনের ‘কাপুরুষতা’র গল্পও এতদ্দ্বারা জাতির স্মৃতিপট হইতে নির্বাসিত করিবার আয়োজন সম্পূর্ণ হয়। তবু অলস, কল্পনাবিলাসী, সংগ্রামবিমুখ জাতি রূপে বাঙালির যে বদনাম, বাঘা যতীন, সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ হইতে সুভাষচন্দ্র অবধি নায়কদের শৌর্যগাথাও তাহা ঘুচাইতে পারে নাই। এত দিনে বুঝি সত্যই ‘পরিবর্তন’ আসিল। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে প্রকাশ, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া জওয়ানের সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান ষষ্ঠ। শ্লাঘনীয়!
সংগ্রামপ্রিয়, যোদ্ধা জাতির ধারণাটি অবশ্য একান্ত ভাবেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের মন-গড়া। ভারতীয় বর্ণপ্রথায় যে ক্ষত্রিয় বর্ণের কথা বলা হইয়াছে, তাহারাও অবশ্য যোদ্ধাই। উচ্চকুলোদ্ভব ব্রাহ্মণের মতো ক্ষত্রিয় যোদ্ধারাও বঙ্গদেশীয় সমাজের ‘আপনজন’ নহেন, যুদ্ধপ্রিয়তা বাঙালির মজ্জাগত নয়। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যখন বাঙালিদের ‘যোদ্ধা’ জাতির তালিকার বাহিরে রাখিলেন, তখন তাহার গূঢ় কারণ ছিল ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহে ‘বেঙ্গল নেটিভ ইন্ফ্যান্ট্রি’র সশস্ত্র বিদ্রোহ। মঙ্গল পান্ডে নিজে বাঙালি ছিলেন না, ইন্ফ্যান্ট্রির আরও অনেকের মতোই ছিলেন ‘পূর্বাইয়া’। কিন্তু সেই হইতে যোদ্ধা জাতির তালিকা হইতে বাঙালি বাদ পড়িয়া গেল, যেমন গেল নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপির সৌজন্যে মরাঠারাও। যে-সব জনগোষ্ঠী ফিরিঙ্গি হটাইতে অস্ত্র ধরে নাই, অধিকন্তু ঔপনিবেশিক শাসনের অনুগত থাকিয়াছে, সেই রাজপুত, শিখ, গোর্খা, গুর্জর, জাঠ, আহির, ডোগ্রা, গাড়োয়ালি, কুমায়ুনি প্রমুখের যোদ্ধা জাতি রূপে শনাক্ত করা হইল। লক্ষ্য ওই সব জনগোষ্ঠী হইতে অধিক সংখ্যায় ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য সৈন্য সংগ্রহ করিয়া তাহাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তথাকথিত যোদ্ধা জাতির উপকথাটির জন্ম এ ভাবেই। উপনিবেশের সাম্রাজ্যিক স্বার্থ সুরক্ষিত করাই ছিল এই রূপকথাটি জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্য।
বাঙালির সেই যে কপাল পুড়িল, ব্রিটিশ বাহিনীতে চাকুরির সুযোগও তদবধি সঙ্কুচিত হইয়া গেল। নদীমাতৃক বঙ্গদেশ এমনিতে অল্প আয়াসেই সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা। ‘অলস’, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত, আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত বাঙালি কবিতা-গান-সংস্কৃতি লইয়া পড়িল। বাহুবলীদের প্রজন্ম লুপ্ত হইল, মেধাশক্তির জাগরণ ঘটিল। সেই জাগরণ যদি ঊনবিংশ-বিংশ শতকে উচ্চবর্ণীয় নাগরিক মধ্যশ্রেণির নবজাগৃতি রূপে পরিচিত হইয়া থাকে, স্বাধীন ভারতে তবে কলিকাতার সাংস্কৃতিক রাজধানী হইয়া ওঠিবার প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণতা পাইয়াছে। কিন্তু ক্রমে যূথবদ্ধ মাঝারিয়ানার সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে মেধাশক্তির সামর্থ্য হ্রাস পায়। সমাজের আনাচেকানাচে বাহুবলীরা পেশিশক্তির আস্ফালন লইয়া সামনে আসে। বেশ কিছু কাল যাবৎই বঙ্গদেশে সেই পেশিশক্তির আবাদ হইতেছে। শিল্প বিদায় লইতেছে, বিনিয়োগের যাবতীয় সম্ভাবনাকে কুলার বাতাস দিয়া তাড়ানো হইতেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগও কমিয়া যাইতেছে। অতএব ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে চাকুরিপ্রার্থীর দীর্ঘ লাইনে গোটা বঙ্গদেশ উঠিয়া আসিতেছে। তাহাতে ক্ষতি নাই, বাঙালির রণযাত্রায় যদি আবার ঢাল মেঘর ঘাগর বাজিয়া উঠে, তাহাতে আর কিছু না হোক, জীবিকা অর্জনের সুযোগ বাড়িবে। সকল কাজই গুরুত্বপূর্ণ, নিরাপত্তারক্ষীর কাজও তাহার ব্যতিক্রম নহে। এবং, ‘যোদ্ধা’ হইবার তাগিদে বাঙালি যদি অতঃপর সত্যই শরীরচর্চায় মন দেয়, ন্যুব্জপৃষ্ঠ কুব্জদের জাতির মঙ্গল হইবে। প্রশ্ন শুধু একটিই। আর কোনও জীবিকা নাই বলিয়াই বর্ষে বর্ষে দলে দলে সেনাবাহিনীতে নাম লিখাইবার প্রবণতা উৎসাহিত হইতেছে না তো?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.