পাঁজাকোলা করে আছড়ে মার দেবলীনাকে
র আগেও একাধিক বার মারামারি হয়েছে বিধানসভার অন্দরে। কিন্তু অতীতের অনেক রেকর্ডই ম্লান হয়ে গেল মঙ্গলবার!
অধিবেশন চলাকালীন বিধানসভার কক্ষে প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের এক মহিলা বিধায়ককে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ট্রেজারি বেঞ্চের কাছে। সেখানে নিয়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলা হল তাঁকে। ঝাঁপিয়ে-পড়া জটলা থেকে দমাদ্দম কিল-ঘুষি-লাথি পড়ল ওই মহিলা বিধায়কের উপরে!
নজিরবিহীন এই ঘটনার সাক্ষী হল বিধানসভার অধিবেশন-কক্ষ। দ্বিতীয়ার্ধের অধিবেশনের শুরুতেই নিগৃহীতা হলেন জঙ্গলমহলের অন্তর্গত বাঁকুড়ার রানিবাঁধের সিপিএম বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী দেবলীনা হেমব্রম। তৃণমূল বিধায়ক মেহমুদা বেগমও বিরোধী-শিবিরের বিধায়কদের হাতে নিগৃহীতা হয়েছেন বলে পাল্টা অভিযোগ উঠল। মেহমুদা ও দেবলীনা মুখোমুখি হয়ে ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়েছেন দেখে তাঁদের সামলাতে এগিয়ে এসেছিলেন সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়। ঠেলাঠেলিতে মন্ত্রীদের বসার জায়গায় তাঁকেও মুখ থুবড়ে পড়তে দেখা যায়। তিন বিধায়ককেই এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। গৌরাঙ্গবাবুর মাথায় চোট পরীক্ষা করতে সিটি স্ক্যানও করানো হয়েছিল। আঘাত গুরুতর নয় বলে সরকারি হাসপাতাল তাঁকে ভর্তি করতে চায়নি। পরে তাঁকে ভর্তি করা হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তবে মেহমুদা বুকে ব্যথার কথা বলায় তাঁকে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রতিবাদ। পোস্টার হাতে কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্র। - নিজস্ব চিত্র
বিধানসভার মধ্যে মহিলা বিধায়ককে শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রী এবং শাসক দলের বিধায়কদের বিরুদ্ধে। মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর, সমীর পাঁজা, পুলক রায়, তপন চট্টোপাধ্যায়কে মারপিটে জড়িয়ে পড়তে দেখা দিয়েছে। তৃণমূলের তরফে অবশ্য যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করে বামেদের বিরুদ্ধেই বিধানসভার মধ্যে ‘গুন্ডামি’র অভিযোগ আনা হয়েছে। যার জবাবে বাম শিবির আবার পাল্টা বলেছে, বিরোধী পক্ষে থাকার সময় যে তৃণমূল ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর বিধানসভার লবিতে ভাঙচুর করেছিল, তারাই এখন শাসক পক্ষে গিয়ে বিরোধীদের শারীরিক নিগ্রহ করে নতুন নজির স্থাপন করল!
গোটা ঘটনাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দিয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এমন ঘটনা না-ঘটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। এর বেশি কিছু মন্তব্য করতে চাই না।” বিরোধী বাম এবং কংগ্রেস অবশ্য এ দিনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্পিকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কংগ্রেসের দাবি, এর পরে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবকে নিয়ে বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে উদ্যোগী হোন স্পিকার।
ঘটনার সূত্রপাত প্রথমার্ধে একটি মুলতুবি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দাবিতে বাম বিধায়কদের বিক্ষোভের সময়ে। এ রাজ্যে টাকা তোলার আর্থিক সংস্থার ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনার দাবি তুলেছিল বামফ্রন্ট। এ ছাড়া, শিল্প গড়ায় রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মুলতুবি প্রস্তাবেও আলোচনার দাবি রাখে কংগ্রেস। প্রস্তাব দু’টি পাঠের অনুমতি দিলেও আলোচনার সুযোগ দেননি স্পিকার। বামেদের মুলতুবি প্রস্তাব পাঠ করার সময় মূল প্রস্তাবের কিছুটা অংশ বাদ দেওয়া হয়, যা নিয়ে সরব হন সূর্যবাবুরা।
সিপিএম বিধায়কেরা এই নিয়ে স্পিকারের টেবিলের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেও প্রথমে কেউই আঁচ করেননি গোলমাল এতটা ব্যাপক হয়ে উঠবে! স্পিকারের টেবিলের ডান দিকে দাঁড়িয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে সিপিএম বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলতেও দেখা যায়। সিপিএম বিধায়ক নাজমুল হকের হাত ধরে সহাস্যে কিছু বলেন তিনি। এর পরেই দেখা যায়, নাজমুল স্পিকারের টেবিল থেকে মাইকটা তুলে নিয়েছেন। সঙ্গে-সঙ্গে দুই শিবিরের ধাক্কাধাক্কি শুরু। নাজমুল পড়ে যান। নাজমুল অবশ্য পরে দাবি করেছেন, ঠেলাঠেলিতে স্পিকারের টেবিলের সামনে টাল সামলাতে না-পেরেই মাইকটা ধরতে গিয়েছিলেন তিনি। সিপিএমের আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা পরে বলেন, “আমরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করার পরেও পার্থবাবু আমাদের বলছিলেন, জমছে না! এর পরে গোলমাল বাড়তে থাকে।”
বস্তুত, প্রথমার্ধেই অধিবেশন-কক্ষ রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। সিপিএমের নাজমুল হক, সুশান্ত বেসরা ও শেখ আমজাদ হোসেন সরকার পক্ষের বিধায়কদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে জড়িয়ে পড়েন। তৃণমূলের ধীমান রায় চেঁচিয়ে বলেন, তাঁর থুতনিতে মারা হয়েছে। ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ চিৎকার করে বিরোধী বিধায়কদের উদ্দেশে কিছু বলতে থাকেন। যা নিয়ে সুশান্ত-আমজাদ পরে দাবি করেন, অশ্লীল মন্তব্য করা হয়েছে তাঁদের উদ্দেশে। স্পিকারের টেবিল ঘিরে তত ক্ষণে বহু বিধায়ক দাঁড়িয়ে। পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে ব্যস্ত। স্পিকার কী বলছেন, সে-দিকে কারও কান নেই। ফলে, বেলা ১২টা নাগাদ স্পিকার সভা স্থগিত করে দেন। স্পিকার সভা ছেড়ে গেলেও বচসা চলতেই থাকে। এমনকী হাতাহাতিও হয়।
এক লক্ষ্য, দুই পথ: বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করছেন বামফ্রন্ট
(বাঁ দিকে) এবং কংগ্রেস নেতারা। —নিজস্ব চিত্র
দ্বিতীয়ার্ধে সভার কাজ শুরু হতেই পরিষদীয় মন্ত্রী প্রথম পর্বের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, “আজ সভায় যা হয়েছে তার নিন্দা করে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।”
তাঁর অভিযোগ, স্পিকারের মাইক ছিনিয়ে নিয়েছেন নাজমুল। স্পিকারকে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করার চেষ্টা, সভার সম্পত্তি নষ্ট ও সভার কাজ পণ্ড করার চেষ্টা করেছেন আমজাদ, সুশান্ত। পার্থবাবু বলেন, “ওদের আঘাতে তৃণমূলের এক বিধায়কের হাত কেটে গিয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।” পার্থবাবুর বলা শেষ হতেই স্পিকার তাঁর রুলিং দিয়ে ওই তিন বিধায়ককে চলতি অধিবেশনের জন্য সাসপেন্ড ঘোষণা করে দেন। প্রতিবাদে কিছু বলতে ওঠেন বিরোধী দলনেতা। কিন্তু স্পিকার তাঁকে কিছু বলতে দেননি। সঙ্গে সঙ্গে বাম বিধায়কেরা ফের স্পিকারের দিকে ধেয়ে যান। উল্টো দিক থেকে পরিষদীয় মন্ত্রী-সহ শাসক পক্ষের একাধিক বিধায়কও তখন স্পিকারের টেবিলের সামনে পৌঁছে যান। এই সময়েই তৃণমূলের মেহমুদা ও সিপিএমের দেবলীনা মুখোমুখি হয়ে পড়েন। ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতির মধ্যে দেবলীনা ও গৌরাঙ্গবাবুকে পড়ে যেতে দেখা যায়। তিনি মাথায় হাত চেপে মাটিতে বসে পড়েন। তৃণমূলের চন্দ্রনাথবাবু, জয়ন্তবাবু, সমীরবাবু, পুলকবাবু, তপনবাবুদের এই সময় মারপিটে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। একটানা মিনিট পনেরো এই পর্ব চলতে থাকে। দেবলীনা পরে অভিযোগ করেন, মন্ত্রী চন্দ্রনাথবাবু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা তাঁকে মারধর করেছেন।
গোলমালের সময়ে অবশ্য পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু, সরকার পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও বিধায়ক সুজিত বসুর মতো কয়েক জন বাকিদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহাও দেবলীনাকে মারের হাত থেকে বাঁচাতে এগিয়ে যান।
বেশির ভাগ বিধায়ক ওয়েলের মধ্যে থাকাকালীনই কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “সভার মধ্যে এক মহিলাকে চ্যাংদোলা করে মারধরের ঘটনা লজ্জাজনক। গণতন্ত্রের মন্দিরকে কলঙ্কিত করা হয়েছে।” এর প্রতিবাদে কংগ্রেস ওয়াক আউট করে। পরে বিকালে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট, দু’পক্ষই আলাদা করে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়।

দেবলীনা মহিলা বিধায়ক। ট্রেজারি বেঞ্চ পর্যন্ত
তাঁর কী কাজ ছিল? গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় কেন
ট্রেজারি বেঞ্চে গিয়েছিলেন? আমাদের আর
ওদের যা সংখ্যা, আমরা সংযত না-থাকলে
অন্য রকম ব্যাপার হত!
পার্থ চট্টোপাধ্যায় (মুখ্য সচেতক, তৃণমূল)


মানুষের ভোটে জিতে বিধানসভায়
এসেছি। অন্যদের যা অধিকার, আমারও
তা-ই। ট্রেজারি বেঞ্চের সঙ্গে কী সম্পর্ক?
তৃণমূলের বিধায়কেরা আমাকে ঘিরে
ধরে নিগ্রহ করেছেন, মেরেছেন।
দেবলীনা হেমব্রম (সিপিএম বিধায়ক)


আমি দেখলাম, দেবলীনাকে কেউ চুলের
মুঠি ধরে, কেউ হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে
গেল ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে। সেখানে ওঁকে
যে ভাবে মারল, মহিলা বিধায়ক হিসেবে
তাতে আমি আতঙ্কিত।
শাওনী সিংহ রায় (কংগ্রেস বিধায়ক)


যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁদের নামেই
এফআইআর করার নজির তো এই
জমানায় আছে। এখন অভিযোগ করলে
ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তার বদলে
অভিযোগকারীদের আক্রমণ করা হয়!
সূর্যকান্ত মিশ্র (বিরোধী দলনেতা)


এক দল বিধায়ক বিধায়কদেরই মারছেন, এমন ঘটনা দেখিনি! স্পিকার চোখের
সামনে সব দেখেও কড়া ব্যবস্থা নিতে পারেননি। বিধানসভার ভিতরে-বাইরে
নিরাপত্তা পাওয়া যাবে কি না, প্রশ্ন উঠে গিয়েছে!
মানস ভুঁইয়া (প্রাক্তন মন্ত্রী)
মারপিট থামার পরে স্পিকার আলোচনার জন্য বিল পেশ করতে বলেছিলেন মন্ত্রীকে। কিন্তু পঞ্চায়েতমন্ত্রী স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “বহিষ্কৃতরা থাকলে সভার কাজ করা যায় না!” তখন স্পিকার সূর্যবাবুকে বলেন, “আপনি বিরোধী দলনেতা। সভার কাজ সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনারও ভূমিকা আছে।” সূর্যবাবুও বলেন, “যাঁদের আপনি শাস্তি দিলেন, তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিলেন না! তাঁদের বলতে দিন।” স্পিকার সভার আইন পড়ে শুনিয়ে দেন, এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বলার সুযোগ দেওয়ার কোনও বিধান নেই।
সূর্যবাবুদের দাবির মুখেও স্পিকার অনড় থাকায় ‘শুধু ওই তিন জন নয়, আমরা সবাই বেরিয়ে যাচ্ছি’ বলে বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে বাম বিধায়কেরা ওয়াকআউট করেন। বিরোধীশূন্য সভায় পাশ হয় তফশিলি জাতি-উপজাতি (চিহ্নিতকরণ) সংশোধনী বিল। বাইরে পোর্টিকোর নীচে সন্ধ্যা পর্যন্ত ধর্না চালিয়ে যান বাম বিধায়কেরা।
ঘটনাবহুল এই দিনে বিধানসভায় উপস্থিত ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু দিনের শেষে কংগ্রেসের এক মহিলা বিধায়কের মন্তব্য, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। আশা ছিল, তাপসী মালিকদের মতো ঘটনা আর হয়তো এ রাজ্যে ঘটবে না। কিন্তু প্রথম বারের মহিলা বিধায়ক হিসাবে আজ যা দেখলাম, তাতে সব স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে! বাংলার মহিলাদের কথা ভেবে আতঙ্ক হচ্ছে!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.