ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার বিরুদ্ধে নামছে রাজ্যও
মোটা টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে লগ্নিকারীদের পথে বসানো আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সক্রিয় হতে হচ্ছে রাজ্যকে। এক দিকে লগ্নিকারীদের প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে যেমন প্রচারে নামা হচ্ছে, তেমনই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তের পরিকাঠামোও গড়তে চাইছে সরকার। আর্থিক অপরাধ দমন শাখাটি এ জন্য ঢেলে সাজার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রের চাপেই রাজ্যের এই উদ্যোগ বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। অন্য অংশের মত, রাজ্যকে নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে অর্থসঙ্কটেই। ভুঁইফোঁড় এই সব আর্থিক সংস্থা ছোট বিনিয়োগকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ায় সরকারি স্বল্প সঞ্চয় দারুণ ভাবে মার খাচ্ছে। অথচ, রাজ্য থেকে যত স্বল্প সঞ্চয় হয়, সেই পরিমাণ কেন্দ্রীয় ঋণ পেতে পারে রাজ্য সরকার। অর্থসঙ্কট মেটাতে কেন্দ্রীয় ঋণ বরাবরই বড় হাতিয়ার রাজ্যের। স্বল্প সঞ্চয় বাড়াতে রাজ্যকে বাধ্য হয়েই বিনিয়োগকারীদের কাছে প্রচার করতে হচ্ছে।
এই সব আর্থিক সংস্থার বিরুদ্ধে রাজ্য ঠিক কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে?
এ ভাবেই জনগণকে সতর্ক করতে বিজ্ঞপ্তি ছড়াচ্ছে স্বল্প সঞ্চয় বিভাগ।
রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী বলেন, “রাজ্য এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করেছিল। তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চিঠি লিখে ওই আইনে তাঁর সম্মতি পেতে ফের দরবার করা হচ্ছে।” অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে তবেই পুলিশ দিয়ে তার তদন্ত করতে পারে রাজ্য। কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করার ক্ষমতা রাজ্যের নেই। সেই ক্ষমতা চেয়েই ২০০৩-এ বামফ্রন্টের আমলে বিলটি বিধানসভায় পাশ হয়। সে বছরের ২৮ ডিসেম্বর থেকে বিলটি রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পড়ে আছে। মন্ত্রকের খবর, ২০০৫-এর নভেম্বরে তা অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রকের বিবেচনার জন্য গেলেও তার পরে আর এগোয়নি। অর্থসচিব জানান, দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকা ওই বিলটিতে ফের রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য।
কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
অর্থ দফতরের কর্তারা জানান, লগ্নিকারীদের সচেতন করতে প্রচারের পাশাপাশি ওই সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তের পরিকাঠামো বাড়ানোর কথা ভাবছে রাজ্য। এফএম রেডিও ও বাংলা খবরের কাগজে টানা সাত-দশ দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হবে, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থার প্রলোভনে সাড়া দিয়ে সর্বস্বান্ত না হয়ে ডাকঘরে টাকা রাখুন। স্বল্প সঞ্চয় অধিকর্তার দফতর থেকেও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের বোঝাতে বিলি হচ্ছে প্রচারপত্রও। অর্থ দফতরের আর্থিক দমন শাখাকে মজবুত করতে বাড়তি ডিএসপি, ইনস্পেক্টর ও সাব-ইনস্পেক্টর নিয়োগ করা হচ্ছে। আটকে থাকা বিলটিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন আদায়ের পদক্ষেপ তো রয়েছেই।
কর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় অর্থ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বার বার এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আর্থিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলছে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে একত্র করে ব্যবস্থা গ্রহণের পন্থা ঠিক করতে বলা হয়েছে। সিআইডি ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিনিধিদেরও এ কাজে লাগানোর সুপারিশ করেছে কেন্দ্র। শুধুই কি কেন্দ্রের চাপে এই ব্যবস্থা, নাকি এই সংস্থাগুলির দৌলতে রাজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? রাজ্য থেকে যত টাকা স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে জমা হয়, রাজ্য ততটাই কেন্দ্রীয় ঋণ নিতে পারে। কর্তারা জানান, সংস্থাগুলি বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ায় এ বছর স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের বিনিময়ে রাজ্য সামান্য ঋণ পেয়েছে। ২০১০-১১ সালে এই খাতে সরকার ১২ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা পেয়েছিল। ২০১১-১২ সালে ৩০০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা রেখে পেয়েছিল ১৬৫৮ কোটি টাকা। আর চলতি আর্থিক বছরে কেবলমাত্র সেপ্টেম্বরে মাত্র ২৫ কোটি টাকা ঋণ মিলেছে। যদিও এ বারেও বাজেটে স্বল্প সঞ্চয় থেকে ৩০০০ কোটি টাকা পাওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুঁইফোড় আর্থিক সংস্থাগুলির লোভনীয় প্রচারে ভুলে কেউ আর ডাকঘরে টাকা জমাতে চাইছেন না। যাঁরা জমিয়েছেন তাঁরাও তুলে নিচ্ছেন। স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির বৈঠকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সামনেই ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা আর্থিক সংস্থাগুলির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে সরব হয়েছিলেন।
অর্থ দফতরের কর্তাদের মতে, লোভে পড়ে যাঁরা এই সব সংস্থায় টাকা রাখছেন তাঁদের স্বার্থ দেখাটাও সরকারের কাজ। মূলত পাঁচ ভাবে কোনও সংস্থা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারে। সেগুলি হল বাজারে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে, মিউচুয়াল ফান্ড গড়ে, ডিবেঞ্চার বিক্রি করে, নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি ও চিট ফান্ড তৈরি করে এবং কোম্পানিতে লগ্নি চেয়ে বা কোম্পানি ডিপোজিট সংগ্রহ করে। চারটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। শুধু কোম্পানি ডিপোজিটের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (আরওসি)। কিন্তু ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সংস্থাগুলি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীর টাকা তুলে নিচ্ছে।
অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, সংগ্রহ করা টাকা বিনিয়োগ করারও নির্দিষ্ট আইন রয়েছে, যা মানা হয় না। আইন বলছে, কোনও কোম্পানি তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি টাকা কোম্পানি ডিপোজিট হিসাবে বাজার থেকে তুলতে পারে না। অথচ ‘গ্রুপ অব কোম্পানিজ’-এর নামে অজস্র কোম্পানি খুলে এ রাজ্যে দেদার টাকা তোলার অভিযোগ উঠছে সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে। দেখা যাচ্ছে, যে কোম্পানির মূলধন ১ কোটি টাকা, তারাও দিব্যি বাজার থেকে কয়েকশো কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এ ছাড়া বেআইনি ভাবে যথেচ্ছ ডিবেঞ্চারও বিক্রি হচ্ছে। কোনও সংস্থা ৫০ জনকে ডিবেঞ্চার বিক্রি করলে তা সেবির নিয়ন্ত্রণে আসে না। তার চেয়ে বেশি হলেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে নাম লেখাতে হয়, সমস্ত তথ্য জনগণের সামনে আনতে হয়। অভিযোগ, এ রাজ্যে সেবির নজরদারি এড়াতে বহু আর্থিক সংস্থা অজস্র শাখা সংস্থার নামে ডিবেঞ্চার বিক্রি করে টাকা তুলছে, অথচ লগ্নি সম্পর্কে কোনও তথ্যই প্রকাশ করছে না। ফলে অধিক প্রাপ্তির আশায় সঞ্চয়কারীরা এই ধরনের সংস্থাতেই টাকা ঢালছেন। স্বল্প সঞ্চয় দফতর এ বার এদের বিরুদ্ধে প্রচারে নামছে। কিন্তু এই সব সংস্থার বিপুল প্রচারের সামনে তা কতটা দাঁড়াতে পারবে, অর্থ দফতরের কর্তারাই সে বিষয়ে সন্দিহান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.