ব্যাগ গুছিয়ে...
লুকোচুরির সৈকতে
ঠাৎ সমুদ্র তাড়া করল!
সন্ধ্যার আকাশ ঘন কালো হতেই আড্ডার ফাঁকে চোখ খুঁজল দুপুরে দেখতে পাওয়া চরটা। সেটিও দিব্যি উধাও। চেয়ার নিয়ে যতই পিছনে যাওয়া, কয়েক মিনিটের মধ্যেই দৌড়ে এসে জল ছুঁয়ে ফেলবে পা। বাকি সন্ধ্যাটা অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায় সমুদ্রের সঙ্গে এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় মেতে। রাত যত এগোয় জলও তত এগিয়ে আসে। আর সন্ধ্যাভর সৈকতজুড়ে শুধুই চেয়ার, আইসক্রিমের গাড়ি, মাছ ভাজার গাড়ি নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করে চলে জলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা।
দিনে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার এ ভাবেই পিছোতে থাকে সমুদ্র। দুপুরে পৌঁছে রীতিমতো মুখ ভার হয়ে যেতে পারে উৎসুক পর্যটকের। বহু আশা করে কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেক গাড়ি চালিয়ে আসার পরেও কি না ছুটে পালাচ্ছে সমুদ্র!
তেমনটা হলও। ভোরে ঘুম থেকে উঠে, সক্কাল সক্কাল রওনা দিয়ে বারোটা নাগাদ ফ্রেজারগঞ্জ পৌঁছে কোনওক্রমে ব্যাগটা হোটেলে রেখে ছুট্টে সমুদ্রের ধারে গিয়ে বেজায় হতাশা দেখা গিয়েছে দলের অধিকাংশের চেহারাতেই। এতখানি বালি পেরিয়ে কি না ওই দূরে চিকচিক করছে এক চিলতে সমুদ্র! জল পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই লেগে গেল রীতিমতো তর্ক। কষ্টে পাওয়া সাধের ছুটি এ ভাবে বালিতে দিতে মোটেই রাজি নয় পর্যটকেরা। সকলেই জানত, তেমন কিছুই দেখার থাকবে না। এই কারণেই বার বার দিঘা, মন্দারমণি গেলেও ফ্রেজারগঞ্জ আসা হয়নি। শুধু এক জনের অনুরোধ রাখতেই এত দূর আসা। কিন্তু ছুটি তো আর ভাবলেই পাওয়া যায় না!
কথা কাটাকাটির মধ্যে এগোতে এগোতেই হঠাৎ মুখে এসে লাগল সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়া। এক মুহূর্তে থমকে গেল তর্ক-বিতর্ক। সামনেই ভ্যান ঠেলে ‘ডাব চাই ডাব’ করতে করতে ডাবওয়ালা আসতেই বদলে গেল দলের মেজাজটা। মিষ্টি জলে চুমুক দিয়ে নোনা হাওয়ায় রঙিন ছাতার তলায় ভাড়ার চেয়ারে বসে জমে উঠল আড্ডা।
সাঁতরে কিছুটা এগোলেই ছুঁয়ে আসা যায় সমুদ্রের মাঝের চর। যদিও তত দূর না যাওয়ার জন্য সরকারি নির্দেশিকার বোর্ড পার করে তবেই পৌঁছনো গিয়েছে সমুদ্রের ধারে। তাই অন্যদের চরে যাওয়া দেখেই কাটল বেলা। দিনে বোঝা না গেলেও বেলা বাড়তে স্পষ্ট হতে থাকে সেই নির্দেশের কারণ।
সূর্য যত পশ্চিমের দিকে ঘেঁষে, আস্তে আস্তে ততই ফ্রেজারগঞ্জের সমুদ্রের চকচকে জলে ঢাকা পড়তে থাকে এই অস্থায়ী দ্বীপগুলো। সন্ধ্যা নামার আগেই জলের মধ্যে উধাও হয়ে যায় সব। এই সমুদ্র সৈকতের এটাও বৈশিষ্ট। নানা স্তরে এখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মজে থাকা যায় জলের রকমারি লুকোচুরি খেলায়।
বিকেলে তিনটের পর থেকেই সমুদ্রের ধারের ভিড়টা গাঢ় হতে দেখা যায়। উৎসাহ সূর্যাস্ত দেখার। তখনও থামে না সমুদ্র-স্নানের হইচই। তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিনভর দেখা যায় স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরার কর্মকাণ্ড। নীল জলের মধ্যে মস্ত জাল নিয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে ব্যবস্থা হয় সন্ধ্যার পসরার।
সে সবের ফাঁকেই কখন যেন জলের কাছে নামতে থাকে সূর্যটা। রুপোলি বালির সমুদ্র সৈকত কিছু ক্ষণেই গোধূলির আলোর ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে কুসুমরঙা। সেই সোনালি সমুদ্রের ছবির জন্য নানা প্রান্তের ফ্রেম-প্রেমীরা দুপুর শেষের আগে থেকে ক্যামেরা-ট্রাইপড নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। এখানকার ছবি-ওয়ালাদের আকর্ষণের মধ্যে লাল-কাঁকড়ারাও অন্যতম। সমুদ্রের ধারে এই কাঁকড়াদের লুকোচুরি খেলা আর ক্যামেরা হাতে তাদের অপেক্ষায় অনায়াসে গড়িয়ে যায় সময়।
সন্ধ্যার ফ্রেজারগঞ্জ এক্কেবারে অন্য মেজাজের। রঙিন ছাতা সরে গিয়ে গড়গড় করে নেমে আসে আইসক্রিম, ঝালমুড়ি আর মাছ ভাজার গাড়ি। সারা দিনটা যে সব মাছ ধরা দেখে কেটেছে, এ বার সেগুলো চেখে দেখার পালা। সূর্যাস্তের পরে বকখালিকে মূলত মাতিয়ে রাখে ক্রমশ এগোতে থাকা সমুদ্র আর সেই মাছ ভাজার ম ম গন্ধ।
ফ্রেজারগঞ্জের কাছেই হেনরিজ আইল্যান্ড। পরের দিনটা সক্কাল সক্কাল হারিয়ে যাওয়া যায় সেখানকার ম্যানগ্রোভ ও সুন্দরীর জঙ্গলে। মোটর বসানো ভ্যানে আধ ঘণ্টা ফাঁকা রাস্তা ধরে গিয়েই হেনরি সাহেবের এই অভিনব অঞ্চল। দ্বিতীয় দিনটা ফ্রেজারগঞ্জের হোটেল ছেড়ে গিয়ে ওঠা যায় সেখানকার সরকারি রিসর্টে।
নিজস্ব বিচ আছে এই হেনরিজ আইল্যান্ডে। বকখালির সমুদ্র ধারের চেয়ে আরও নির্জন। রুপোলি বালিতে চকচকে এই সৈকতে কাটানো যায় একটা নিরিবিলি দুপুর। সন্ধ্যার পরে নাকি কখনও কখনও রয়াল বেঙ্গল তেনারা ঘুরে ফিরে দেখেন হেনরি সাহেবের এই সাম্রাজ্য। তাই সূর্য ডোবার পরে আর সমুদ্রের ধারে না গিয়ে রিসর্টের ভিতরেই গল্প-আড্ডায় কাটিয়ে দেওয়াই চল সেখানে।
বৈচিত্র্যময় দু’টো দিন কাটিয়ে পরের সকাল থেকে ফের শহুরে ভিড়ভাট্টার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে ঘুরে আসা যায় বাজার অঞ্চল থেকে। দুপুরের পরে সময় জেনে পৌঁছে যেতে হবে ভেসেল ঘাটে। ভেসেল পার হওয়ার অপেক্ষার সময়টুকু কাটতে পারে নদীতে ভাসমান বজরা দেখতে দেখতে। নিমেশে মন পৌঁছবে ছোটবেলার রূপকথার কোনও রাজার গল্পে। সেই রঙিন ভাবনার সঙ্গে মিশে কোন ফাঁকে যেন উধাও হয়ে যাবে ছুটি শেষের মন খারাপটা।

ছবি: হিন্দোল ঘটক

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে গাড়িতে গেলে কাকদ্বীপ পেরিয়ে নামখানা পর্যন্ত যেতে হবে।
সেখান থেকে ভেসেল পেরিয়ে আরও আধ ঘণ্টার পথ ফ্রেজারগঞ্জ। ট্রেনে যেতে হলে
নামতে হবে নামখানা স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে মিনিট চল্লিশের পথ।
ধর্মতলা থেকে সোজা বাসও যায় ফ্রেজারগঞ্জ পর্যন্ত।
কোথায় থাকবেন
সরকারি এবং বেসরকারি থাকার জায়গা আছে। কলকাতা থেকে থাকার
জায়গা ঠিক করে যাওয়া যায়। গিয়ে স্পট বুকিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.