প্রবন্ধ ১...
তাঁর রাজনীতির দিন ফুরিয়েছে, এই যা ভরসা
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে লজ্জার দিন কোনটা, সপ্তাহখানেক আগেও এই প্রশ্নটা শুনলে ভাবতে হত। এখন আর সংশয় নেই। তারিখটা ২২ নভেম্বর ২০১২, যে দিন সংসদের উভয় কক্ষেই সাংসদরা উঠে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করে বাল কেশব ঠাকরের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। কস্মিনকালেও রাজ্যসভা বা লোকসভার সদস্য ছিলেন না তিনি। থাকলে, সম্মান না জানিয়ে উপায় থাকত না রীতির বাড়া বিড়ম্বনা নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তো সেই বালাই ছিল না। তবু কে জানে কেন, হয়তো ঠাকরের শেষযাত্রায় দশ লক্ষ মানুষের ভিড় দেখেই, মুম্বই দাঙ্গার প্রধানতম স্থপতিকে সম্মান জানানোর বাসনা হল কেন্দ্রের শাসকদের। বা, হয়তো পুরনো দোসর বলেই।
১৯৯২-৯৩ সালের বম্বে দাঙ্গা ঠাকরের মুকুটে সেরা পালক, অবশ্যই। কিন্তু তাঁর রক্তক্ষয়ী রাজনীতির (কোন যুক্তিতে তাকে রাজনীতি বলব, তা অবশ্য প্রশ্ন) সূচনা ১৯৬৯-৭০’এ। ১৯৬৯-এর ফেব্রুয়ারিতে কন্নড়ভাষীদের তাড়িয়ে কর্নাটক সংলগ্ন মহারাষ্ট্রের খানিক এলাকা দখল করার লড়াইয়ে ৫৫ জন কন্নড় নিহত হন। ১৯৭০-এর মে মাসে ভিওয়ান্ডির দাঙ্গায় নিহত হন ১৪২ জন মুসলমান। বাল ঠাকরে-র ‘মরাঠি মানুস’ রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত। তার ওপর দাঁড়িয়েই একের পর এক শত্রু বেছে নিয়েছেন তিনি। কখনও দক্ষিণ ভারতীয়, কখনও গুজরাতি, কখনও উত্তরপ্রদেশবাসী, কখনও বিহারি, কখনও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর মোড়কে বাঙালি, কখনও উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দারা। আর সব সময়ই মুসলমানরা। কখনও শিবাজি পার্কে, কখনও মাতোশ্রীর বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাল ঠাকরে শত্রু নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কী ভাবে সেই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, জানিয়ে দিয়েছেন তা-ও। তিনি তাঁর সমর্থকদের ধিক্কার দিয়েছেন, তারা শান্ত বলে! আত্মঘাতী বাহিনী তৈরি করতে বলেছেন। তলোয়ার হাতে রাস্তায় নামতে বলেছেন। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের ‘আদেশ’ দিয়েছেন। সমাজতত্ত্ববিদ আশিস নন্দী লিখেছেন ঠাকরের রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়ে তেমন কথা হয়নি, তার কারণ, তাঁর হাতে মার খাওয়া মানুষদের বেশির ভাগই সমাজের একেবারে নিচু তলার মানুষ, যাঁদের নিয়ে ভদ্রজনের তেমন মাথাব্যথা নেই।
ঠাকরের সমর্থকরা অবাধ্য হননি। ইতিহাস জানে, কী ভাবে তলোয়ারের ধারে, লাঠির দাপটে বম্বেতে শিবসেনার প্রশ্নাতীত আধিপত্য তৈরি হয়েছে। কেন ৮৭ বছরে বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর আশঙ্কাতেও মুম্বই স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তর আরব সাগরের হাওয়ায় ভাসছে। সেই ১৯৭০ থেকে।

তবে, বাল ঠাকরের উত্থানকে শুধু তলোয়ারের ধার দিয়ে ধরা যাবে না। তাঁর রাজনীতির শিকড়ে কোনও আদর্শবাদ ছিল না। ১৯৬০-এর দশকের ভারতের, বিশেষত মহারাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তাঁর রাজনীতির রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল।
একটা নয়, দুটো রাস্তা। প্রথমটা হল সাধারণ মানুষের মনে ক্রমবর্ধমান হতাশা। ভারতের যে দুটো শহর স্বাধীনতার ঢের আগে থেকেই প্রকৃত অর্থে ‘কসমোপলিটান’, বম্বে ছিল তার একটা। দ্বিতীয়টা, আমাদের কলকাতা। ১৯৬০-এর দশকে নাকি বম্বের হুজ-হু’র তালিকায় একটিও মরাঠি নাম খুঁজে পাওয়া যেত না। গুজরাতি থেকে দক্ষিণ ভারতীয়, পার্সি থেকে বাঙালি সবাই ছিল, ভূমিপুত্ররা বাদে। খেয়াল করার, ১৯৬০-এ ভাষার ভিত্তিতে মরাঠিদের জন্য তৈরি হয়েছিল নতুন রাজ্য, মহারাষ্ট্র পুরনো বোম্বাই প্রদেশ থেকে গুজরাতকে ছেঁটে ফেলে। ফলে ভাষাভিত্তিক আবেগ এবং অনিশ্চয়তা তখনকার মহারাষ্ট্রে, বিশেষত বম্বেয়, ঘোর বাস্তব। এ দিকে, স্বাধীন ভারতের নিয়তির অভিসারের ফল সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব সুখের হয়নি। মানুষের রোজগার তেমন বাড়েনি, চাকরি বেড়েছে আরও কম। নিয়ন্ত্রণের বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া সীমায় বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতা চরম বাস্তব। কালোবাজারি, দুর্নীতি ইন্দিরা গাঁধীর আমলের দিকচিহ্নগুলোও ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যে সুতীব্র হতাশা থেকে ১৯৭৩ সালে রাগী যুবক অমিতাভ বচ্চনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান ঘটেছিল রুপোলি পর্দায়, ঠিক সেই হতাশাই বম্বের রাজনীতির মাটিতে ভূমিপুত্রবাদী আগুনখেকো বাল ঠাকরেকে দাঁড় করিয়ে দিল।
প্রয়াত। বাল ঠাকরের শেষযাত্রায় তাঁর কাট-আউট হাতে
সমর্থকদের মিছিল। মুম্বই, ১৮ নভেম্বর, ২০১২। ছবি: পি টি আই
অমিতাভ বচ্চনকে আরও খানিক ক্ষণ সঙ্গে রাখা যাক। ‘দিওয়ার’-এর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। সেখানে অমিতাভ বচ্চনের বাবা ছিলেন আপসহীন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। কী ভাবে তাঁকে হঠিয়ে দেওয়া হল, সে গল্প সিনেমার, কিন্তু সত্তরের দশকের মহারাষ্ট্রে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের যে কোনও উপায়ে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন ছিল অতি বাস্তব। এই বাস্তবই বাল ঠাকরের উত্থানের দ্বিতীয় রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। দুটি দৃষ্টান্ত স্মরণীয়। ১৯৭০ সালে ডাকসাইটে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কৃষ্ণ দেসাই খুন হয়েছিলেন, তার আগে বম্বের গিরনি কামগরে সিপিআই-এর ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে আগুন লেগেছিল। এবং স্মরণীয়, দেসাই খুন হওয়ার পরেই বম্বের রবার্ট মানি হাই স্কুলের জনসভায় নিজের দলের ছেলেদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ঠাকরে। সেই সঙ্গে ‘লাল ভাই’-দের প্রতি সতর্কবাণী: বম্বেতে শিবসেনার আধিপত্য স্বীকার করে না নিলে কী ফল হতে পারে।
সেই সময় বম্বেতে শিবসেনা লোকমুখে একটি ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল ‘বসন্তসেনা’। বামপন্থীদের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, মাহারাষ্ট্রের দুই মুখ্যমন্ত্রী বসন্তরাও নায়ক এবং বসন্তদাদা পাটিল-এর গুণ্ডাবাহিনী হিসেবেই কাজ করত শিবসেনা। তখন বম্বেতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কংগ্রেস জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে আর বামপন্থীরা পায়ের নীচে নতুন মাটি পাচ্ছে। স্বভাবতই বম্বের শিল্পপতিদের চক্ষুশূল ছিল এই বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আর তার নেতারা। বাল কেশব ঠাকরের রাজনৈতিক উত্থানের প্রথম ধাপ ছিল বামপন্থীদের বম্বেছাড়া করা। বামপন্থীরা তিক্ত অভিযোগ করে গিয়েছেন, ঠাকরের এই গা-জোয়ারি চলেছে কংগ্রেসের সক্রিয় মদতে। প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার তীব্রতম সমর্থক ছিলেন বাল ঠাকরে। ইন্দিরা গাঁধীর ভক্ত ছিলেন। সঞ্জয় গাঁধীরও।
বম্বে আর কলকাতার মধ্যে প্রথমটা স্বাধীন ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী হয়ে উঠল আর দ্বিতীয়টার কী হল, আমরা মোক্ষম জানি। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে বাল ঠাকরেকে যেমন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, তেমনই সুবোধ বাঁড়ুজ্জেকেও স্মরণ করতে হবে। এই দ্বিতীয় জন এস ইউ সি আই-এর শ্রমিক নেতা, যুক্তফ্রন্টের আমলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন, খ্যাতি অর্জন করেছিলেন অবশ্য ‘ঘেরাও মন্ত্রী’ হিসেবে। কলকাতায় যখন সুবোধবাবু নিজে একের পর এক কারখানা ঘেরাও করতে মদত দিচ্ছেন, মালিক-শ্রমিক সংঘাতকে চরম সীমায় নিয়ে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়েই বম্বেতে বাল ঠাকরে ট্রেড ইউনিয়নের কোমর ভাঙছিলেন। সুবোধবাবু সত্তরের দশকের গোড়াতেই প্রয়াত, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তাঁর উত্তরাধিকার বহমান। বম্বে থেকে শহরটার নাম বদলে মুম্বই করে দেওয়ার পরেও বাল ঠাকরে বদলাননি। তিনি শেষ পর্যন্ত একই রকম ‘শিল্পবন্ধু’ ছিলেন।
স্বভাবতই, মহারাষ্ট্রের সাধারণ মানুষকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি রাজনীতির মূলধারায় এসেছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির কণামাত্র রাখেননি তিনি। গিরনগাঁও-এ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন ভাঙার সময় তাঁর মুখে শ্রমিক স্বার্থের কথা ছিল বন্ধ করে শ্রমিকদের ক্ষতি করা তিনি মেনে নেবেন না। একটি ছোট পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ১৯৮২ সালে গিরনগাঁওতেই দত্ত সামন্তের এক বছরের বস্ত্রশিল্প কারখানার ধর্মঘটের সময় সেখানে কর্মী-সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লাখ। তার এক দশক পরে, মুষ্টিমেয়। কারণ যেখানে কারখানাগুলো ছিল, সেখানে জমির দাম আকাশ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছিল। সেই জমি প্রোমোটারদের হাতে চলে গিয়েছে, জলের দরেই। শিবসেনা তখন মহারাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন।

যে দুটি পথ মিলেমিশে ঠাকরেকে মহারাষ্ট্রের রাজনীতির ভরকেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল, তারাই এক সময় পরস্পরবিরোধী হয়ে দাঁড়াল। ১৯৯০-এর গোড়া থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল, ঠাকরের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মুম্বইয়ে ‘মরাঠি মানুস’-এর আবেগের জোর আর আগের মতো থাকবে না। তার কারণ শহরটার আর্থিক উন্নতি। শিল্পশহর থেকে বম্বে সম্পূর্ণত বাণিজ্যনগরী হয়ে উঠল। যে পরিমাণ টাকা হাওয়ায় উড়তে আরম্ভ করল, তার টানে ফের গোটা দেশের লোক মুম্বইয়ে পাড়ি জমাল। মরাঠি ভূমিপুত্ররাও বুঝলেন, ‘বহিরাগত’দের সঙ্গে মারপিট করার চেয়ে নিজের মতো কাজ করে গেলেই লাভ শহরে সবার বেঁচে থাকার মতো টাকা আছে, আর যোগ্যতা না থাকলে ভূমিপুত্র হয়েও লাভ নেই। কথাটা ঠাকরেও ঠিক সময়েই বুঝেছিলেন। মরাঠি খণ্ডজাতীয়তাবাদ থেকে তাঁর রাজনীতির ভরকেন্দ্র সরে এল সংকীর্ণ হিন্দু জাতীয়তাবাদের দিকে। বহুশত্রুবাদী ঠাকরে একক শত্রুর রাজনীতিতে সরে এলেন। সেই রাজনীতির শীর্ষবিন্দু নিঃসন্দেহে ১৯৯২ সালের দাঙ্গা। পরিচিত অভিযোগ শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্ট চেপে দেওয়ার ঢের চেষ্টা শিবসেনা করেছিল, কারণ সেই রিপোর্টে কী থাকবে, বাল ঠাকরের মতো স্পষ্ট কেউ জানতেন না। প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র মোদী ঠাকরেকেই নিজের ‘মার্গদর্শক’-এর আসন দেন।
কিন্তু হায়! সেই হিন্দুত্ববাদেরই বা বাজার রইল কোথায়? ১৯৯২ সালের পর ভারতে আর সেই মাপের দাঙ্গা হয়নি। ২০০২ সালে গুজরাতে দাঙ্গা হয়নি, ওটা সংগঠিত গণহত্যা। দেশের রাজনৈতিক অক্ষটি ধর্ম থেকে সরে জাতপাতের ময়দানে চলে গেল মুলায়ম সিংহ থেকে মায়াবতী, লালুপ্রসাদ থেকে নীতীশ কুমার সেই ময়দানের তারকা। যে ‘মরাঠি মানুস’-এর বুলি তাঁর রাজনীতির মেরুদণ্ড, সেই মরাঠিরাও যে একটিমাত্র সত্তা নয়, তার ভিতরেও জাতপাতের ভাঁজ বিলক্ষণ বর্তমান, এই সত্য ঠাকরেও টের পেয়েছিলেন বলেই অনুমান।
তবে, বাল ঠাকরে রাজনীতির এই খেলাটি আর ধরতে পারেননি। তাঁর শিবসেনাও নয়, রাজ ঠাকরেও নন। ফলে, বাল ঠাকরে জীবিত থাকলেও তাঁর, বিশেষ করে তাঁর ঘরানার রাজনীতির, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কত দিন থাকত, সে প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মাস কয়েক আগে অসম দাঙ্গার ‘প্রতিবাদে’ মুম্বইয়ে কিছু মুসলমান ভয়ানক অসভ্যতা করে। ১৯৮০-র দশক হলে ঠাকরের প্রতিক্রিয়া কী হত, অনুমান করা সম্ভব। ২০১২-এ রাজ ঠাকরে একটা বড় মিছিল বের করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই অবধিই। শিবসেনা-ব্র্যান্ডের রাজনীতির যে দিন ফুরিয়েছে, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ হয় না।
এই আকালে এ এক বিরল সুসংবাদ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.