অস্বস্তি কাটানোর অস্ত্র বেচারাম, সিঙ্গুর পাশে দাঁড়াচ্ছে রবীন্দ্রনাথের
দিনভর মুখে কুলুপ এঁটে থাকার পরে রাতে ‘রবি-ক্ষত’ সামাল দিতে নামল তৃণমূল। আর সেই কাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে দিলেন বেচারাম মান্নাকেই। মন্ত্রিসভার কাজে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের পরিবর্তে যাঁর উপরে আস্থা রেখেছেন তিনি।
সোমবার রাতে এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথবাবু তৃণমূল নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করে বলেন, “আমার নাকের ডগায় তোলাবাজি চলছে। দলের লোকেরাই করছে। এটা রাজা জানেন না, হতে পারে না।” গুরুত্বহীন দফতরে কোণঠাসা রবীন্দ্রনাথবাবুর এই বিস্ফোরক মন্তব্যে সাড়া পড়ে যায় তৃণমূলে। অস্বস্তিতে পড়েন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেটা এতটাই যে, সাধারণত সব বিষয়ে তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া দিতে অভ্যস্ত তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা বিষয়টি নিয়ে রা কাড়েননি গোটা দিন। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে এড়িয়ে গিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত রাতে আসরে নামলেন বেচারাম।
সিঙ্গুর আন্দোলনে তাঁর নেতা তথা রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথবাবুকে কটাক্ষ করে নয়া কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম বলেন, “উনি অনৈতিক কাজ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান করেছেন। আসলে কৃষি দফতরে যে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার কথা, তা উনি করতে পারছিলেন না।” এই মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার যে, রবীন্দ্রনাথবাবুর ক্ষোভকে দফতর খোয়ানো-জনিত হতাশার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই প্রচার করতে চাইছে তৃণমূল।
বেচারাম অবশ্য আরও একটা কারণ দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, “হয়তো সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষক, বর্গাদারদের দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই রবীন্দ্রনাথবাবু এমন মন্তব্য করেছেন।” যে অভিযোগের পিছনে অন্য গভীর তাৎপর্যের ইঙ্গিত পাচ্ছেন রাজনীতির কারবারিরা। তাঁদের মতে, ন্যানো-বিরোধী আন্দোলনে তৃণমূলের পাশে থাকা সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক জমিদাতারা তৃণমূল ক্ষমতায় আসার দেড় বছর পরেও জমি ফিরে না-পেয়ে হতাশ। তাঁদের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে। বেচারামের এই মন্তব্য তারই ইঙ্গিত। তাঁরা আরও বলছেন, সেই ক্ষোভ সামাল দিতেই শুক্রবার সিঙ্গুরে আসছেন মমতা। তার আগে এই ঘটনা তৃণমূল নেত্রীর অস্বস্তি বাড়াল।
নিজের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। মঙ্গলবার দীপঙ্কর দে-র তোলা ছবি।
কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, তৃণমূলের সামনে আরও বড় সঙ্কট হল তোলাবাজি। যা নিয়ে মুখ খুলেছেন রবীন্দ্রনাথবাবু। দলীয় সূত্রই বলছে, জেলায় জেলায় নানা স্তরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন তৃণমূল কর্মী-নেতারা। যার জেরে বাড়ছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সেই খবর দলনেত্রীর কাছেও আসছে। সেই কারণেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সম্প্রতি একাধিক বার তিনি বলেছেন, তৃণমূল তোলাবাজের দল নয়। দলের প্রয়োজন হলে তিনি নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করে টাকা তুলবেন। গত শনিবারই মিলন মেলায় হস্তশিল্প মেলার উদ্বোধনে মমতা বলেছেন, “আমরা লোভীর দল নয়। একটা পয়সাও পার্টির নামে তুলি না।” তার আগে শিল্পপতিদের সঙ্গে বিজয়া সম্মেলনেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কাউকে টাকা দেবেন না, এমনকী তৃণমূলের নাম করে চাইলেও নয়।
এই জল্পনায় ইন্ধন জুগিয়ে মঙ্গলবার বহরমপুরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেছেন তোলাবাজি হচ্ছে। উনি যখন বলছেন, তখন সে কথার সত্যতা আছে। মুখ্যমন্ত্রীও বলছেন তোলাবাজি চলবে না। এটাই আসলে প্রমাণ করে তোলাবাজি চলছে।”
গত কয়েক মাসে বীরভূমের লোবা, লাভপুর, নানুর, নদিয়ার তেহট্ট-সহ নানা জায়গায় তৃণমূলের গোষ্ঠী সংঘর্ষ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বিবদমান নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসেছেন। শুক্রবার, সিঙ্গুরে যাওয়ার দিনেই সকালে তাঁর কালীঘাটের বাসভবনে উত্তর ২৪ পরগনার জনপ্রতিনিধিদের বৈঠকে ডেকেছেন মমতা। দলীয় সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত ভোটের প্রস্তুতি পর্বে জেলায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং কিছু নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই ওই সভা ডাকা হয়েছে।
প্রকাশ্যে অবশ্য সে কথা স্বীকার করা স্বাভাবিক কারণেই সম্ভব নয় তৃণমূলের পক্ষে। সেই কারণে, রবীন্দ্রনাথবাবুর অভিযোগ উড়িয়ে বেচারাম এ দিন বলেছেন, “উনি নিজেই দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়ে গিয়েছেন। তোলাবাজির অভিযোগ উনি ভবিষ্যতে প্রমাণ করতে পারবেন কি?” বেচারামের আরও কটাক্ষ, “দুর্নীতির দায়েই কিছু দিন আগে আনন্দনগর পঞ্চায়েতের প্রধান এবং সিঙ্গুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকেও সরিয়ে দিয়েছিল দল। এক সময় ওই দু’জন তো মাস্টারমশাইয়ের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত ছিলেন!”
বেচারাম তাঁর মাস্টারমশাইকে দুষলেও সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের একটা বড় অংশ কিন্তু রবীন্দ্রনাথবাবুর পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলেও তাঁদের অনেকেই বলছেন, “ঠিকই করেছেন মাস্টারমশাই। নানা ধরনের অপ্রিয় ঘটনা ঘটছে চার দিকে। অনেকেই অনেক কিছু জানে। উনি নেহাতই ভদ্র মানুষ বলে সব কথা খোলাখুলি বলতে পারছেন না।”
রবীন্দ্রনাথবাবুর প্রতি তৃণমূলের ব্যবহারেও মর্মাহত সিঙ্গুর। সুব্রত রায় নামে এক অনিচ্ছুক চাষির কথায়, “মাস্টারমশাইকে এক বার স্কুল দফতর দেওয়া হল। তার পর কৃষি। এ বার সেখান থেকেও সরানো হল। দল যা করছে, তাতে আমরা মর্মাহত।” অনিচ্ছুক চাষি শ্রীকান্ত পাত্র, মনোরঞ্জন পাত্রদের বক্তব্য, “আমাদেরই দল ওঁর সঙ্গে এই আচরণ করায় আমরা দুঃখিত। অসহায় বোধ করছি।” নতুন দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক রবীন্দ্রনাথবাবু ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রিসভায় তাঁর অনুপস্থিতি সিঙ্গুরের আন্দোলনকেও দুর্বল করতে পারে বলে মনে করেন অনেকে।
উনি নিজেই দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়ে গিয়েছেন।
এ সব তো শুধু আমার কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আগে বলেছেন
যে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায় করা যাবে না।
এর উল্টো মতও অবশ্য শোনা গেল এ দিন সিঙ্গুরে। বেড়াবেড়ি বাজারের বাসিন্দা আর এক অনিচ্ছুক চাষি সুরজিৎ দাস বললেন, “মাস্টারমশাইয়ের সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক, সিঙ্গুর আন্দোলনের মুখ বলতে শুধু দিদিই (মমতা)।” তৃণমূলের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মীর বক্তব্য, দলের প্রবীণ সদস্য হয়েও এ ভাবে বিরোধীদের হাতে সমালোচনার অস্ত্র তুলে দিয়ে ঠিক করলেন না রবীন্দ্রনাথবাবু।
তৃণমূলের এই অস্বস্তির পুরো ফায়দা তুলেছেন বিরোধী নেতারা। প্রাক্তন পঞ্চায়েতমন্ত্রী আনিসুর রহমান এ দিন ফোন করেন রবীন্দ্রনাথবাবুকে। বাস্তব প্রকাশ্যে আনায় তাঁকে অভিনন্দন জানান আনিসুর।
পিছিয়ে নেই বিজেপি-ও। রবীন্দ্রনাথবাবুর মতো ‘সৎ ও নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তিকে তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিন্হা। তাঁর অভিযোগ, “সিপিএমের লুঠেরা ও গুন্ডারা জার্সি বদল করে তৃণমূল দল ভরিয়ে তুলেছে।” সিঙ্গুরে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোদ্ধা ছিলেন পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড। রবীন্দ্রনাথবাবু প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এলাকায় ওঁর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। কঠিন সময়ে সিঙ্গুর থেকে বিধানসভায় জিতে এসেছিলেন। মন্ত্রিসভায় তাঁকে ঠিক মতো মর্যাদা দেওয়া উচিত ছিল। তিনি যখন এই রকম অভিযোগ করছেন, বুঝতে হবে সরকার এবং দলে কিছু গোলমাল আছে!”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “রবীন্দ্রনাথবাবু ঠিকই বলেছেন। তৃণমূলে অনেক তোলাবাজ আছে। আগেও এমন অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু ওদের শাস্তি হয় না।”
মাস্টারমশাই নিজে এ দিন কী বলছেন? “এ সব তো শুধু আমার কথা নয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই আগে বলেছেন যে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায় করা যাবে না,” বলেন রবীন্দ্রনাথবাবু। দলনেত্রীর উপরে তাঁর ‘পূর্ণ আস্থা’ বলে জানিয়েছেন, আবার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন তিনি। কিন্তু ক্ষোভ দলের অন্দরে জানালেন না কেন? রবীন্দ্রনাথবাবুর সাফাই, “কিছু কথা কানে এসেছিল। সে জন্যই বলেছি। তবে কিছুই প্রমাণিত নয়। সে সব খামোখা দলকে বলতে যাব কেন?” তাঁর বক্তব্যে আখেরে দলের মঙ্গল হবে বলেই মনে করেন রবীন্দ্রনাথবাবু। আপাতত এই আশার সুতোতেই ঝুলছে তৃণমূলের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.