পুস্তক পরিচয় ১...
মন ভাল করে দিতে পারবে
কাস্টডিয়ানস অব দ্য পাস্ট/ ১৫০ ইয়ার্স অব দি আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া,
সম্পা: গৌতম সেনগুপ্ত ও আভা নারায়ণ লাম্বা। আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ২৫০০.০০
ত্রিশ থেকে ষাট ফুট উঁচু, কয়েকশো টন ওজনের দুটো পাথরের থাম। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভেড়ার চামড়া আর খড়-বিচালি জড়িয়ে তুলোর গদিতে শুইয়ে বিয়াল্লিশ চাকার বাহনে চাপিয়ে মাটির উপর দিয়ে এনে শেষে যমুনায় বার্জে চাপিয়ে দিল্লি আনা হল। আট হাজারেরও বেশি লোককে এ কাজে লাগানো হয়েছিল। শুধু আনাই নয়, দিল্লির দুটো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, অনেকটা উঁচুতে তুলে সবার নজরে পড়ার মতো করে আবার বসানোও হল। কী লেখা আছে থাম দুটোর গায়ে? হিন্দু, মুসলমান সব বিশেষজ্ঞকে ডাকা হল, কেউই বলতে পারলেন না। যিনি থাম দুটোর জন্য এত কাণ্ড করলেন, তিনি কিন্তু কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক নন। বস্তুত তাঁর সময়ে প্রত্নতত্ত্বের কোনও ধারণাই তৈরি হয়নি। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শা তুঘলক চতুর্দশ শতকে মৌর্য সম্রাট অশোক স্থাপিত স্তম্ভের লিপি পড়াতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু এত অসাধারণ পুরাকীর্তি যে সংরক্ষণ করা উচিত, সেটা ঠিকই বুঝেছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে এমন পুরাকীর্তি তো অগণিত। পঞ্চদশ শতক থেকে শুরু করে নিকোলো কন্তি, লুডোভিকো বার্থেমা, তাভার্নিয়ে, থেভেনো, বার্নিয়ে, কার্স্টেন নিবুর, ওয়াল্টার হ্যামিল্টনের মতো অজস্র ইউরোপীয় এখানে এসেছেন এবং স্থাপত্য-ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা যখন দেখেছেন, তখন অনেক স্থাপত্যই রীতিমতো ‘জীবিত’। আবার আঠেরোর শেষ আর উনিশ শতকের গোড়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সব কর্মচারী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন, কিংবা যাঁরা গুপ্তধনের মতো প্রত্নবস্তু সংগ্রহের জন্য বৌদ্ধ স্তূপ থেকে শুরু করে নানা প্রাচীন কীর্তির অবশেষ খুঁড়ে নষ্ট করেছেন, তাঁদের রেখে যাওয়া বিবরণ থেকেই কিন্তু আস্তে আস্তে দেশের অতীত অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
১৭৮৪-তে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি তৈরি হওয়ায় উইলিয়াম জোন্স-এর হাত ধরে প্রাচীন ভারত-ইতিহাসের অনুসন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেল। জোন্স বা প্রিন্সেপের গবেষণার পাশাপাশি কলিন ম্যাকেঞ্জির প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে দক্ষিণ ভারত সমীক্ষা, ফ্রান্সিস বুকাননের মহিসুর, নেপাল, ব্রহ্মদেশ এবং শেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে অসম-উত্তরবঙ্গ-বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমীক্ষা, ড্যানিয়েল খুড়ো-ভাইপো, হজেস এবং অন্যান্য ইউরোপীয় শিল্পীর আঁকা ছবি থেকে ভারতীয় পুরানিদর্শন বিষয়ে বিপুল তথ্যভাণ্ডার গড়ে উঠছিল। খবর মিলছিল ঐতিহ্য বিনষ্টিরও, অমরাবতীর বিখ্যাত বৌদ্ধস্তূপের চুনাপাথরের বহু ভাস্কর্যফলক চুন তৈরির জন্য পুড়িয়ে ফেলা হয়। নানা মহল থেকে সরকারের উপর চাপ বাড়ছিল প্রাচীন কীর্তি রক্ষার জন্য। বিচ্ছিন্ন কাজও হচ্ছিল, যেমন লর্ড হার্ডিঞ্জের উদ্যোগে ১৮৪৪-এ কোম্পানি লেফটেনান্ট মেজর গিলকে অজিন্ঠায় পাঠায় সামগ্রিক নথিকরণের জন্য। ২৭ বছর ধরে তিনি অসামান্য কাজ করেছিলেন, কিন্তু অগ্নিকাণ্ডে সে সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আবার সিপাহি বিদ্রোহের পরপরই কোম্পানির বাহিনীর হাতে দিল্লির জামি মসজিদ ধ্বংস হওয়া ঠেকাতে পঞ্জাবের চিফ কমিশনার জন লরেন্সকে সক্রিয় হতে হয়েছিল। তবে দিল্লি বা লখনউয়ে বহু স্থাপত্য বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় চিরকালের জন্যই লুুপ্ত হয়ে যায়। তাজমহল ভেঙে মার্বেল নিলাম করার কথাই যখন উঠেছিল, তখন এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
সিকান্দ্রায় আকবরের সমাধি। শিল্পী: ই ডব্লিউ স্মিথ, ১৯০১
এই অবস্থাতেই আলেকজান্ডার কানিংহাম ভারত সরকারের আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভেয়ার নিযুক্ত হলেন। পাঁচ বছর পরেই আবার সে কাজ স্থগিত। ১৮৭১-এ আবার কানিংহামকেই ডিরেক্টর জেনারেল করে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া গড়া হল। উপলবন্ধুর পথে তার যাত্রা, কখনও সরকারি আনুকূল্য, কখনও ব্যয়সংকোচের চাপ। তবে এও ঠিক, উনিশ শতকের পৃথিবীতে ফ্রান্সকে বাদ দিলে প্রত্নকীর্তি রক্ষায় ভারত ছিল প্রথম সারিতেই, এমনকী ব্রিটেনে পর্যন্ত ১৮৮০-র দশকের আগে এ বিষয়ে কোনও আইন হয়নি। কানিংহামের পর্ব সার্ভের এমন এক অধ্যায়, প্রত্ন- অনুসন্ধানই যখন গুরুত্ব পেয়েছে, সংরক্ষণ নয়। খোঁড়াখুড়ি করা হয়েছে মূলত প্রত্নবস্তু উদ্ধারের জন্য। আবার কার্জনের চেষ্টায় বিশ শতকের গোড়ায় সার্ভে যখন ফের পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেল, নতুন ডি জি হয়ে এলেন জন মার্শাল, সে আর এক অধ্যায়। ১৯৩১-এ রায়বাহাদুর দয়ারাম সাহনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। তত দিনে সাহনি হরপ্পা, আর সার্ভের আর এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদড়োর হদিশ পেয়েছেন। ১৯৪৪-এ সার্ভের নেতৃত্বে এলেন মর্টিমার হুইলার। পঞ্চাশের দশকে অমলানন্দ ঘোষ বিপুল কর্মকাণ্ডের সূচনা করেছিলেন, ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’-র মতো মূল্যবান মুখপত্রের প্রকাশ শুরু হয় তখনই। প্রথম মহিলা মহাধ্যক্ষও ছিলেন এক বিশিষ্ট বাঙালি প্রত্নবিদ, দেবলা মিত্র। ঘটনাচক্রে প্রত্নতত্ত্ব সর্বেক্ষণের দেড়শো বছর উদযাপিত হল আর এক বাঙালি মহাধ্যক্ষ, গৌতম সেনগুপ্তর কার্যকালে, যখন সারা দেশে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি স্থাপত্য জাতীয় গুরুত্বের তকমা পেয়ে সংরক্ষণাধীন, যার আঠেরোটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। অনেকদিন বন্ধ থাকার পর ‘এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ আবার প্রকাশিত হয়েছে এই পর্বেই।
জাতীয় প্রতীক। সারনাথ উৎখননে পাওয়া অশোকস্তম্ভের শীর্ষ।
দেড়শো বছর উদযাপনের সূচনায় সর্বেক্ষণ প্রকাশ করেছিল জন কে-র লেখা টু চেরিশ অ্যান্ড কনজার্ভ/ দি আর্লি ইয়ার্স অব দি আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। দুর্লভ ছবিতে ভরা, শ’খানেক পাতার সুমুদ্রিত বইটিতে কে ইতিহাসটা ধরে দিয়েছিলেন। সমাপ্তি পর্বে সর্বেক্ষণের উদ্যোগেই হাতে এল গৌতম সেনগুপ্ত ও আভা নারায়ণ লাম্বা সম্পাদিত বইটি। দু’জন সম্পাদকের সঙ্গে অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায়, বি আর মনি এবং জাহ্নবীজ শর্মা তুলে ধরেছেন ভারতীয় প্রত্নচর্চায় অপেশাদার অনুসন্ধান এবং সার্ভের গোড়াপত্তন, সূচনাপর্বের তথ্য সংকলন ও ছবি তোলার ইতিবৃত্ত, সার্ভের প্রথম একশো বছর, উৎখনন-লিপিপাঠ-সংগ্রহশালা স্থাপন ও প্রত্নকীর্তি সংরক্ষণের বৃত্তান্ত। এই খুঁটিনাটি তথ্য সংকলনের পাশাপাশি আছে বিস্ময়কর ছবির ভাণ্ডার— দেশের বিভিন্ন অংশে সর্বেক্ষণের দেড়শো বছরের কর্মকাণ্ডের নানা দিকচিহ্ন, যার অনেকটাই এই প্রথম এখানে ছাপা হল। সর্বেক্ষণের আর্কাইভে অনেক কালের ধুলো ঘেঁটে বহু যত্নে এই সব দুর্লভ ছবি একত্র করা বড় কম কথা নয়।
সাধারণ মানুষের সহযোগিতা ছাড়া পুরাকীর্তি সংরক্ষণ শুধু সরকারি উদ্যোগে অসম্ভব। তবু, ইতিহাসরসিক মানুষ যখন কোনও কোনও পুরাক্ষেত্রে গিয়ে দেখেন সরকারি সংরক্ষণের একমাত্র চিহ্ন নীল এনামেলের বোর্ডটিও প্রায় পুরাকীর্তি হতে বসেছে, কিংবা বোর্ড লাগানোর আগেই তা বিলুপ্তির পথে, তখন মন খারাপ লাগে বইকী। তেমন দিনে এই বই বোধহয় কিছুটা মন ভাল করে দিতে পারবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.