ব্যাগ গুছিয়ে... বরফচূড়ার হাতছানি
প্তাহব্যাপী সিকিমের ‘স্প্রিং কার্নিভাল’-এ তখন গোটা সিকিম যেন দুলছে। সিকিমিজরা যেন বসন্তের ফুলের মতোই রঙিন ও প্রাণবন্ত। গ্যাংটক থেকে লাচেন যাওয়ার পথে মঙ্গনে গাড়ি থামতেই সেই কার্নিভালের রেশ মন ছুঁয়ে গেল। গ্যাংটক থেকে ৬৭ কিলোমিটার। দুর্দান্ত, প্রাণোচ্ছল জেলা শহর মঙ্গন পেরিয়ে আসতেই সিংঘিক।
নির্মেঘ আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি মারে বার বার। সিংঘিকের রূপ যেন শিল্পীর ক্যানভাসে অপরিকল্পিত আঁচড়। মেঘ-রৌদ্রের তুলির টানে সে প্রতি মুহূর্তে বদলাতে থাকে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। পাহাড়ি ঝরনা বয়ে চলেছে। মেঘপিওনের গোছা গোছা মেঘের খাম ঢেকে দিচ্ছে সামনের পিচ ঢাকা রাস্তা-সহ পাহাড়ি গ্রামগুলোকে। গাড়ির গতি কমতে থাকে। চুংথাং এখান থেকে ২৬ কিলোমিটার। তার আগেই মেঘ সরে যেতে থাকল, থেমে গেল বৃষ্টি।
ফুল আর অর্কিডে ঘেরা পাহাড়ি জনপদ ছবি বদলে দিচ্ছে, সামনে ‘চুংথাং’ আসছে। এখানে একটু জলযোগের জন্য সাময়িক বিরতি। ঠান্ডাটা বাড়ছে, এই মুহূর্তে ১৩/১৪ ডিগ্রি। জমজমাট চুংথাং থেকে একটা রাস্তা লাচুং হয়ে ইয়ুমথাং, অপরটি নির্ধারিত আমাদের জন্য লাচেন হয়ে গুরুদোংমার। দু’দিক থেকে আসা লাচেন-চু আর লাচুং-চু মিলেছে এখানে। ‘চু’ মানে নদী। অপরূপা এই দুই মিলেমিশে নাম বদলে সমতলে নামছে ‘তিস্তা’ হয়ে।
পড়ন্ত বিকেলের আলোটা হঠাৎ ভ্যানিশ করে দিল পাহাড়। এখান থেকে আরও চড়াই। প্রায় ২০ কিমি দূরত্বে লাচেনে রাত্রিবাস। দুরন্ত ভ্রমণে এ বার গন্তব্য ৯৫০০ ফুট। ড্রাইভার তাড়া দেন। তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিই। জমজমাট বাজার, দোকান, সেনাছাউনি পেরোতে থাকি দ্রুত। সামনে অন্ধকারের ঘনঘটায় আকাশচেরা বিদ্যুতের ঝলকানিতে থেকে থেকেই দেখতে পাচ্ছি আদিগন্ত খাদের গভীর ভয়ঙ্করতা। বাইরে এ বার বৃষ্টির সঙ্গে বরফকুচি। লো-ভোল্টেজের আলোয় লাচেনের হোটেলগুলো রহস্যময়ী। এই দুর্গম দেশে গরম ভাত আর মুরগির ঝোলের পরে শরীর যখন কম্বলে ঢাকল, আকাশ তখন মেঘ সরিয়ে নিয়েছে।
জমাট ঘুমের শেষে, হিমেল জমাটি ঠান্ডায় খুব ভোরে বেরিয়ে পড়তে হল গুরুদোংমারের পথে। রাতের রহস্যময়ী ‘লাচেন’ আলো ফুটতে ধরা পড়ে অন্য রূপে। বছরে কটা মাস ছাড়া লাচেনে বসবাসকারী হাতে গোনা। জীবনধারণে যাবতীয় উপকরণ আসে নিচ থেকে। তাই লাচেন যতই সুন্দরী হোক বেশ কিছুটা সময় সে বড়ই নিঃসঙ্গ। তখন সে লুকিয়ে থাকে ঘন তুষার-ওড়নায়। লাচেন মনাস্ট্রির প্রেয়ার হুইলে হাত রেখে প্রার্থনা ‘ওম্ মণিপদ্মে হুম্...’, যেন পেরোতে পারি বাকি পথটা, হোক সুগম।
লাচেন থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার অনবদ্য পথের শেষে, এখানকার পর্যটকদের জন্য এটাই গুরুদোংমারের বেস ক্যাম্প। গ্যাংটক থেকে নিয়ে আসা নুডল্স আর ফলের সমাহারে গা-গোলানো কমে গেল। ভারতীয় জওয়ানদের সদা জাগ্রত শিবির থেকে সাবধানতার কড়াকড়ি।
পথচলতি লাচেন-চু সঙ্গেই ছিল, এ বার জেমু-চু সঙ্গ নিল। অপূর্ব বরফি নদীগুলো এখানে ঠিক যেন আইস অন্ দ্য রক। আরও, আরও উপরে উঠে যাওয়া পথের বাঁকে বাঁকে ক্রমে খুলে যাচ্ছে পাহাড়ের অফুরন্ত রূপ-যৌবন। উধাও হচ্ছে সবুজ। আকাশে আজ শুধুই নীলের পসরা। তিব্বতীয় রুক্ষ পাথুরে সৌন্দর্যে যে দিকে তাকাও বরফ আর ঝলসানো পাথরের লুকোচুরি।
ধূসর শীতল মরুভূমি উপত্যকার মধ্যে গাড়ি ছুটছে। থাঙ্গু থেকে ৪৭ কিলোমিটার। অনাবিল সৌন্দর্যের ঝুলি ভরে ১৭১০০ ফুট উপরে যখন থামলাম তখন গুরুদোংমার হ্রদ আকাশ ছুঁতে চাইছে। সবুজ সায়রের জাদু আয়নায় গুরুদোংমারের বরফচূড়া যেন মুখ দেখছে বার বার।
হ্রদটা এক বার পাক খেলেই নাকি ভাগ্য খুলে যাবে। রঙিন রাডিশেল ডাক (ব্রাহ্মণী হাঁস) উড়ে গেল হ্রদ ছুঁয়ে। সর্বধর্ম প্রার্থনাঘরের সামনে রঙ-বেরঙের প্রার্থনা পতাকা ছুঁয়ে জওয়ানদের দেওয়া কড়া গরম মিষ্টি চায়ে অক্সিজেনের সমতা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। ফিরতি পথে গুরুদোংমারের প্রচণ্ড বাতাসের শব্দে যেন আহ্বান, ‘আবার এসো বন্ধু’।

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে ট্রেনে শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি।
সেখান থেকে ২ রাত ৩ দিন বা ৩ রাত ৪ দিনের প্যাকেজ ট্যুর।
কোথায় থাকবেন
গ্যাংটকেও প্রচুর হোটেল আছে। গুরুদোংমার প্যাকেজেও থাকা-খাওয়ার সব বন্দোবস্ত থাকে।
কখন যাবেন
বর্ষা ও বেজায় শীত ছাড়া যে কোনও সময় যাওয়া যায়। মার্চ থেকে মে সবচেয়ে ভাল।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.