অনাস্থা আনার হুমকি মমতার, খুশি বিজেপি, বিপাকে বাম
হাকরণে দাঁড়িয়ে আজ নাটকীয় ভাবে একটি বোমা ফাটালেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবে তাঁর দল। এই অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করার জন্য বাম, বিজেপি-সহ সবাইকে আহ্বান জানালেন তিনি। মমতার এই রাজনৈতিক গুগলির মোকাবিলায় কংগ্রেস সক্রিয় হয়ে উঠেছে আজ থেকেই। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা পড়ার আগেই সরকার আস্থা প্রস্তাব আনতে চাইতে পারে। ইউপিএ-র যুক্তি হল, তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করায় সরকার সংখ্যালঘু হয়ে গিয়েছে। কাজেই লোকসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের দায় রয়েছে। স্পিকারের কাছে সেই সুযোগ চাইতে পারে কংগ্রেস।”
মমতা আজ বলেন, “এই সরকারের আর এক দিনও ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়। এটা একটা লুঠেরা সরকার। জনগণ-বিরোধী এই সরকারকে আমরা বোল্ড আউট করব। সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিনেই তৃণমূল অনাস্থা প্রস্তাব আনবে।” দলগত ভাবে যোগাযোগ না-করলেও মহাকরণে দাঁড়িয়েই সব দলকে তাঁদের অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করার অনুরোধ জানিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, “আমরা সব দলকে, এমনকী কংগ্রেসের মধ্যে যাঁরা জনগণকে ভালবাসেন, তাঁদেরও এই অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকের পর মহাকরণে সাংবাদিকদের মুখোমুখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার। ছবি: সুদীপ আচার্য
শেষ পর্যন্ত মমতার পক্ষে অনাস্থা প্রস্তাব আনা সম্ভব হবে কিনা, সেই প্রশ্ন অবশ্য থাকছেই। কারণ অনাস্থা প্রস্তাব আনতে গেলে অন্তত ৫০ জন লোকসভার সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন। লোকসভায় তৃণমূলের সদস্য সংখ্যা ১৯। এক সাংসদের দল এসইউসি-ও অনাস্থা সমর্থন করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু বাকি সাংসদ কোথা থেকে আসবে? সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু আজ বলেন, “অনাস্থা আনবে কী করে! আগে সংখ্যা জোগাড় করুক। তার পর বড় বড় কথা বলুক।” অনাস্থা মোকাবিলার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হলেও মমতাকে কোণঠাসা করার রণকৌশলে কংগ্রেসের প্রশ্ন, সংখ্যা পেতে তিনি কি তা হলে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবেন? একই প্রশ্ন বিমানবাবুর।
মমতার অবশ্য ব্যাখ্যা, “এটা (অনাস্থা প্রস্তাব) কোনও ধর্মীয় বিষয় নয়। নির্বাচনী সমঝোতারও ব্যাপার নয়। তাই আমরা সবাইকে পাশে চাইছি। বিজেপি এলেও ক্ষতি নেই।” তাঁর সাফ কথা, অনাস্থা প্রস্তাবে বিজেপি-র সমর্থন চাওয়ার সঙ্গে এনডিএ-র দিকে ঝোঁকার কোনও সম্পর্ক নেই। তৃণমূল সূত্রেও বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটের কথা ভেবে কোনও ভাবেই বিজেপি-র হাত ধরা সম্ভব নয়।
তবে শেষ পর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাব আনা না গেলেও তাঁদের কোনও ক্ষতি নেই বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। তাঁদের মতে, মমতা একটা মোক্ষম চাল দিয়েছেন। তিনি সকলের সমর্থন চেয়েছেন। প্রস্তাব আনা না-গেলে কারা দুর্নীতির পক্ষে, আর কারা বিপক্ষে সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল বলে প্রচার চালানো যাবে।
বিজেপি কিন্তু মমতার প্রস্তাবকে সমর্থন করতে প্রস্তুত। লালকৃষ্ণ আডবাণী আজ বলেন, “মমতার বক্তব্যকে নীতিগত ভাবে আমরা পূর্ণ সমর্থন করছি। অনাস্থা প্রস্তাব পেশ হলে এবং স্পিকার তা গ্রহণ করলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দলীয় অবস্থান জানাব।” বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, কী বিষয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হচ্ছে, তার ভাষা কী হচ্ছে, এ সব অনেক খুঁটিনাটি দিক রয়েছে। সংসদীয় আইন অনুযায়ী না হলে এই সব কারণে প্রস্তাব খারিজ হয়ে যেতে পারে। এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলি নিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে আলোচনা করতেও বিজেপি নেতারা প্রস্তুত।
কিন্তু সিপিএম তথা বাম দলগুলি কী করবে?
সিপিএম নেতারা আগেই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ভোটাভুটি-সহ আলোচনার জন্য নোটিস দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এ-ও জানেন, নোটিস দিলেই যে ভোটাভুটি হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ভোটাভুটি-সহ আলোচনা হবে কি না, তা সরকারের উপরই নির্ভর করছে। এ বিষয়ে সরকারকে বাধ্য করা সম্ভব নয়। বামেরা এ-ও জানিয়েছেন যে, তাঁরা সংসদ অচল করতে চান না। সে ক্ষেত্রে শুধু আলোচনা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
বামেদের এই প্রস্তাব নিয়েও আজ প্রশ্ন তুলেছেন মমতা। তিনি বলেন, “সিপিএমের বন্ধুদের বলব, কংগ্রেসের কথায় কেন প্রস্তাব পেশ করছেন?
এই সরকারকে বাঁচানো হচ্ছে। আপনারা প্রস্তাব আনলে আমরা সমর্থন করব। কিন্তু আমার আশঙ্কা কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হবে।”
অনাস্থা প্রস্তাবের কথা ঘোষণা করে দিয়ে কংগ্রেস-বিরোধিতার যে তাস মমতা খেলেছেন, তা কী ভাবে সামলানো হবে, সেটা সিপিএমের সামনে জরুরি প্রশ্ন। তাদের সঙ্কট দ্বিবিধ। খুচরো ব্যবসার মতো সিপিএমের ইস্যু মমতা কার্যত ‘হাইজ্যাক’ করে নিয়েছেন। সেখানে মমতার অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন না করলে যদি এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, সিপিএম-ই কংগ্রেসের ‘সেফটি ভাল্ভ’ হিসেবে কাজ করছে, তা হলে মুশকিল। আবার অনাস্থা সমর্থন করলেও সিপিএমের আলাদা করে কোনও গুরুত্ব থাকবে না।
এটা একটা লুঠেরা সরকার। জনগণ বিরোধী
এই সরকারকে আমরা বোল্ড আউট করব।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কংগ্রেস-বিরোধিতা কতটা করা হবে, সিপিএমের অন্দরে সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে কংগ্রেস-বিরোধিতার থেকেও মমতার বিরোধিতা করা তাদের পক্ষে বেশি জরুরি। আবার কেন্দ্রেও কংগ্রেসকে দুর্বল করার থেকে মমতা এবং বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। সেই কারণেই মমতাকে অন্য আঞ্চলিক দলগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন করতে আগেভাগে খুচরো ব্যবসা নিয়ে ভোটাভুটির নোটিস দিয়ে মাঠে নেমেছিলেন বামেরা।
তবে পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। সিপিএমের একটি অংশ বলছে, ভোটের পরে প্রয়োজনে কংগ্রেসকে সমর্থন করা যেতে পারে। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গে ‘কংগ্রেস-সিপিএম ভাই ভাই’ বলে মমতার প্রচারে আখেরে দলের ক্ষতি হবে। ভোটের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে দলের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে।
তাই বামেরা মনে-প্রাণে চাইছেন, মমতার অনাস্থা প্রস্তাব যাতে শেষ পর্যন্ত ধোপে না টেকে। তাঁর হুমকির পুরোটাই চমক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিমান বসু। তাঁর বক্তব্য, এখনও এফডিআই-এর বিরুদ্ধে মমতার কোনও আন্দোলন দেখা যায়নি। দুবরাজপুর-তেহট্ট থেকে নজর ঘোরানোর জন্যই মমতার অনাস্থা প্রস্তাবের চাল কি না, সেই প্রশ্নও তুলছেন বামেরা।
কী করবেন মুলায়ম সিংহ যাদব ও মায়াবতী? বাম-কংগ্রেস-মমতা, সকলের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখছেন মুলায়ম। উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়ে বীরত্ব দেখাচ্ছেন। আবার ভোটের পর কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার
স্বপ্নও দেখছেন। ফলে সরকারকে ফেলে দেওয়ার খেলায় তিনি সিপিএমের সঙ্গে থাকবেন, না কি মমতার সঙ্গে থাকবেন, না কি সরকারকে রক্ষা করবেন সেটা স্পষ্ট নয়। মায়াবতীও কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই চলছেন।
এই অবস্থায় ঘর গোছাতে নেমে পড়েছেন কংগ্রেস নেতৃত্বও। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ইউপিএ-র শরিকদের পাশাপাশি মায়াবতী ও মুলায়মের সঙ্গে নৈশভোজ সেরেছেন। আজ তিনি লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিকেও নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বাল ঠাকরের মৃত্যুর জন্য বিজেপি-র অনুরোধে নৈশভোজ বাতিল করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বামেদেরও আমন্ত্রণ জানাবেন। নবীন পট্টনায়ক, জয়ললিতা, নীতীশ কুমারদের কাছেও দূত পাঠিয়ে যোগাযোগ রাখছে কংগ্রেস। নীতীশ তাড়াতাড়ি ভোট চাইলেও কংগ্রেসকে খুব বেশি চটানোর পক্ষে নন।
শেষ পর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাব আসুক বা না-আসুক, কংগ্রেস অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। দলীয় মুখপাত্র রশিদ আলভি বলেন, “মমতা সাম্প্রদায়িক শক্তির সমর্থন নিয়ে অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন কি না, সেটা তাঁর বিষয়। তবে সরকার যথেষ্ট মজবুত। আমরা এর মোকাবিলা করব।” বরং ভোটাভুটিতে জিতে গেলে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের মতো সংস্কারে সংসদের সিলমোহর আছে বলেই প্রচারে নামার পরিকল্পনা করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.