স্পিন আর বীরু-অস্ত্রে নয়া উদ্যমে শান দিচ্ছে টিম সচিন
তাঁর হেয়ারস্টাইলিস্ট স্বপ্না ভাবনানি ‘বিগ বস’-এ চলে গিয়েছেন বলে কি চুলের এই অবস্থা? নইলে যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি চুলের ব্যাপারে এত সযত্ন। প্রত্যেকটা টেস্ট সিরিজ শুরু করেন নতুন চুলের স্টাইল দিয়ে, তাঁর এ বারের ছাঁটটা তো পাড়ার নাপিতের কাছে কাটিয়ে আসার মতো!
আনন্দবাজারের প্রশ্ন শুনে ধোনি হাসলেন, “কতকটা তাই। একেবারে মিলিটারি ছাঁটে চলে গেলাম। ব্যাক টু বেসিকস।”
ভারত অধিনায়কের কথা শুনে মনে হল তাঁর নতুন ছাঁটটা টেস্ট সিরিজে ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিরও যেন প্রতীক! ব্যাক টু মিলিটারি বেসিকস। স্পিন, স্পিন এবং স্পিন।
পশ্চিম আমদাবাদে টিম হোটেল থেকে মোতেরা যাওয়ার রাস্তার দু’ধারে এক মাইলেরও বেশি লম্বা দূরত্বে দেওয়ালগুলো চমৎকার অঙ্কনে সজ্জিত। যাকে বলে গ্র্যাফিটি। মোটেও সেগুলো রাজনৈতিক দেওয়াল লিখন-টিখন নয়। দারুণ ডিজাইন সম্পন্ন এক-একটা পেন্টিং। ভারতের আর কোনও শহরে এমন সুসজ্জিত, খোপ-খোপ করে এত দূরত্বের দেওয়াল-লিপি আছে বলে মনে হয় না। ঠিক করে জানা হল না ছাত্র-ছাত্রীতে অধ্যুষিত এই এলাকার কারা এগুলো করেছে? ম্যারিয়ট কোর্টইয়ার্ড হোটেল থেকে মর্নিং ওয়াক করার দূরত্বে আইআইএম আমদাবাদ। তারা নয়। হয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনের ছাত্র-ছাত্রীরা। নয়তো গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইনিং বিভাগ।
এদের কারওকে দিয়ে যদি মোতেরা স্টেডিয়ামে ঢোকার আগে ম্যাচের সম্ভাব্য দেওয়ালচিত্র আঁকানো যেত, তা হলে অনিবার্য ভাবে সেই ছবিটা হত এ রকম: সাহেব ব্যাটসম্যান হুমড়ি খেয়ে ফরোয়ার্ড খেলছে। আর তার ডাইনে-বাঁয়ে-পিছনে ঘিরে রেখেছে ক্লোজ ইন ফিল্ডার।

রণনীতির দুই নির্ধারক। বোলিং মেশিনের পাশে সচিন। সঙ্গে কোচ ফ্লেচার।
গ্রেম হিক ওই রকম সাফল্য নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ঢোকার পর লিডসে মার্শালের প্রথম বলটাই পেয়েছিলেন হিমশীতল বাউন্সার। হিকের নাক ছুঁয়ে কিপারের হাতে পৌঁছয়। টিভিতে এর পর রিচি বেনো সেই বিখ্যাত মন্তব্যটা করেন, গ্রেম হিক ওয়েলকাম টু টেস্ট ক্রিকেট! মোতেরায় যখন বল ঘুরবে এবং গড়াবে টিভি বক্সে পাশাপাশি বসা দীর্ঘদিনের দুই বন্ধু সৌরভ এবং রাহুল বলার সুযোগ পাবেন।
অ্যালেস্টার কুক, ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অব স্পিন!
এ দিন ইংল্যান্ড অনুশীলনে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। প্রথম দু’এক ওভার পেসাররা নেটে বল করার পর সবাই হুমড়ি খেয়ে স্পিন খেলা অভ্যেস করছে। বিদেশি দল ভারতে এসে স্পিন খেলার ব্যাপারে সব সময় জোর দেয়।
কিন্তু এত খুল্লমখুল্লা, এত ক্ষুধার্ত ভাবে সবাই এসেই স্পিন খেলছে আগে দেখিনি।
আসলে প্রথম টেস্টের আগে স্পিনে তৈরি হওয়ার জন্য ইংল্যান্ড পরিকল্পিত ভাবে যে তিনটে ওয়ার্ম আপ ম্যাচ খেলেছে। তাতে আরও বড় পরিকল্পনা ভেজে তাদের স্পিন খেলার সুযোগই দেওয়া হয়নি। পরিকল্পনা লিখছি এ জন্য যে, বেরুটিন যে সব ব্যাপার তিনটে ম্যাচেই ঘটে তা ডিজাইন ছাড়া হতে পারে না। পিটারসেনরা দু’সপ্তাহেরও বেশি এ দেশে কাটিয়ে স্পেশ্যালিস্ট স্পিন খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ৪০ ওভার। অমিত মিশ্র-র ১৭ ওভার। জয়ন্ত যাদব নামক অখ্যাত আর এক স্পিনারের ২৩ ওভার। তা-ও তিনটে ম্যাচেরই তৃতীয় দিনে কোনও ম্যাচের ক্যাপ্টেন স্পিনারকে বল করতে ডাকেনি। যে সময়টা বিদেশি ব্যাটসম্যানদের আসল পরীক্ষা। রহস্যজনক ভাবে খেলানো হয়নি প্রথম টিমের দু’চার জন স্পিনারকে। আর এক জনকে খেলানো হয়েছে। বল করানো হয়নি। এতগুলো ঘটনা কখনও কাকতালীয় হতে পারে?
ধোনিকে জিজ্ঞেস করা হল ছকটা কি আপনার? তিনি হালকা হেসে ব্যাপারটাকেও হালকা করে দিতে চাইলেন, “ও সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে আমি জড়িত থাকি না।”
মনে হয় সত্যি কথাই বললেন। আইডিয়াটা শুনলাম ডানকান ফ্লেচারের। তিনি জানেন ০-৪-এর প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডকে স্পিন-উপোসী রাখাটা কত উপকারী হতে পারে। এ ধরনের সার্বিক স্ট্র্যাটেজিতে সিদ্ধহস্ত হল অস্ট্রেলিয়া। সফরের শুরু থেকে এটা করার জন্য কখনও-সখনও যেমন নির্লজ্জ আর নির্মম হতে হয় সবাই সেটা করতে চায় না। ভারত এই প্রথম করল।

সহবাগকে তৈরি করতে বোলিং মেশিনে নিজেই।
ফাটকায় যদি কাজ হয়, ভারতীয় ক্রিকেটে বহু বিলম্বে হলেও ফ্লেচার-যুগ অবশ্যই শুরু হবে!
এমনিতে ভারতীয় ক্রিকেটে যুগ গোড়াপত্তনে আর একটা জিনিস খুব দরকারি। সচিনবাবার বিভূতি। প্রাক্তন কোচ গ্যারি কার্স্টেন সেই বিভূতি প্রথম দিন থেকে পেয়েছেন যেহেতু তিনি সচিনকে নেটে ব্যক্তিগত প্র্যাক্টিস দিতেন। দ্রুতই তাঁর আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। আর সচিনের আস্থাভাজন হওয়া মানে দশ নম্বর জনপথের প্রকাশ্য সম্মতি নিয়ে কংগ্রেসে ঢোকা। টিম ইন্ডিয়ার সনিয়া যে সচিন সেটা মোতেরায় যে উইকেটের ওপর প্রতিদিন ঝাঁট দেয়, সে-ও জানে।
ফ্লেচারকে প্রথমে ধর্তব্যের মধ্যেই নেয়নি সনিয়া শিবির। বরঞ্চ গুজরাত ক্রিকেট সংস্থার প্রেসিডেন্টকে যে চোখে দেখেন সনিয়া, সেটাই বরাদ্দ ছিল ফ্লেচারের জন্য। ০-৮-এর দু’টো অভিশপ্ত সিরিজে তেমনই চলেছে। বুধবার অবশ্য ফ্লেচার-সচিনে পারস্পরিক শরীরী ভাষা দেখে বোঝা গেল পরিস্থিতি ঘুরে গিয়েছে। সেরা বিভূতি না পান, ফ্লেচার আর মোটেও নরেন্দ্র মোদী নন। বরং সচিন এখন প্রকাশ্যেই তাঁকে নম্বর দিচ্ছেন।
আসলে সিরিজ শুরুর আগে যেটা মনে হচ্ছে টিম ধোনি আর নেই। টেকনিক্যালি যতই টিম ইন্ডিয়া লেখা হোক, সেটাও নেই। আদতে টিম সচিন।
বিশ্বকাপের সময় সচিনের যেমন ইনভলভমেন্ট ছিল অথচ পরবর্তী কালে টিম সংক্রান্ত নানান বিতর্কে আক্রান্ত হয়ে তা চলে যায়, সেটা আবার ফেরত। নিজের শততম সেঞ্চুরির জন্য ছুটতে গিয়েও কোথাও যেন টিম-লক্ষ্যটা সরে গিয়েছিল। বুধবার প্রমাণ পাওয়া গেল সেটা নিজের জায়গায় ফেরত এসেছে।
নইলে যে তেন্ডুলকরের গত সিরিজে রান না পাওয়া নিয়ে এমন জাতীয় বিতর্ক বেধে গিয়েছিল তিনি নিজেকে ছেড়ে এ ভাবে অন্যদের নিয়ে পড়বেন কেন! যুবরাজকে গত ক’দিন সস্নেহ সময় দিয়েছেন। এ দিন আর একটা অবিশ্বাস্য ছবি তাঁর কল্যাণে ক্রিকেটমিডিয়া দেখল। তা হল, বোলিং মেশিনের ওপরে হেলমেট-আর্মগার্ড, প্যাড পরা অবস্থায় সহবাগকে অনুশীলন করিয়ে যাওয়া। উঁচু যে পাটাতনের ওপর উঠে মেশিন থেকে বলগুলো থ্রো করতে হয়, সেখানে সাধারণত কেউ প্যাড-ট্যাড পরে ওঠে না। যদি বা ওঠে ব্যাট করে উঠে হেলমেট খুলে-টুলে ফেলে। এই সচিন যখন সহবাগকে প্র্যাক্টিস করাচ্ছেন, তখন তিনি নিজে ব্যাটই করেননি।
দেখে-টেখে পরিষ্কার মনে হচ্ছে ধোনি টস করতে যাবেন। ফিল্ড-টিল্ডও বদলাবেন। কিন্তু নীতি নির্ধারণ, টিমের দর্শন তৈরি, প্লেয়ারদের ম্যাচ ফিট রাখা এটা করবেন যুগ্ম-স্ট্র্যাটেজিস্টরা! তেন্ডুলকর ও ফ্লেচার!
বীরু সহবাগকে নিয়ে তাঁর এত পিছনে পড়ার কারণ যতই স্পিনারদের ভেলকি হাতে থাক। সহবাগই হতে পারেন টিম সচিনের এক নম্বর ম্যাচ উইনার। ব্যাটিংয়ের সমীকরণটাই যিনি বদলে দিয়েছেন। স্টার ক্রিকেটের হিন্দি ধারাভাষ্যের উদ্বোধন উপলক্ষে যিনি ভারতীয় ক্রিকেটমাঠে দীর্ঘ চার বছর বাদে ফিরছেন সেই কপিলের কাছে মুখ্য আকর্ষণ সহবাগ। “আমার তো কখনও-কখনও মনে হয় ভিভও এত খুনে ছিল না,” বলছিলেন কপিল।
সহবাগ-পূর্ব যুগে ওপেনারদের স্ট্র্যাটেজি থাকত বিপক্ষের এক নম্বর ফাস্ট বোলারের ফার্স্ট স্পেলটা সাবধানে খেলে দাও। ওকে উইকেট দিও না। বাকিদের মারো। সহবাগ-দর্শন সম্পূর্ণ বিপরীত। এক নম্বর বোলারটাকেই প্রথম মারো। যদি সফল হও, বাকি টিম এমনিই শুয়ে পড়বে।
গত পনেরো মাসে ভারতীয় টাকার বাজারও এতটা পড়েনি টেস্ট ক্রিকেটে টিম যে ভাবে এক থেকে পাঁচ নম্বরে ধপাধপ নেমে গেছে। এর প্রধান কারণ সহবাগের ব্যাটে ভাটা। তাই বীরুর ব্যাটে জোয়ার আনানোর জন্য সচিন এমন আদাজল খেয়ে লেগেছেন।
নতুন গুজরাতি বছরের আবাহন হল এ দিন। পথেঘাটে লোকে একে-অপরকে সম্ভাষণ করছে, “কেম ছো? বেয তা বরষ। কেমন আছেন? শুভ নববর্ষ।” ভারতীয় ক্রিকেটও তার শুভ নতুন ক্রিকেটপঞ্জিকার দিকে তাকিয়ে। যা শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার। চাইছে ইংল্যান্ড সিরিজের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর একে অপরকে যাতে ক্রিকেটমোদীরা বলতে পারেন।
“কেমন আছেন? ৪-০ সিরিজ জেতাটা দারুণ হল, বলুন।”

ছবি: উৎপল সরকার




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.