সুরক্ষা কবচ
হাসপাতালের বিছানায় সপ্তাহ কয়েক শুয়ে থাকতে হলেই কর্পূরের মতো উবে যাবে কষ্টের সঞ্চয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য বিমায় আমাদের বড় অনীহা। বড্ড অরুচি। হয় এই বিমা করার বিষয়টি সযত্নে, সন্তর্পণে এড়িয়ে যাই আমরা। নইলে করি একেবারে গা-ছাড়া ভাবে। এজেন্টের পরামর্শে। প্রকল্পের সুবিধা-অসুবিধা সে ভাবে যাচাই না করেই। অথচ এই বিমা শুধু আপনার চিকিৎসার খরচ জোগাড়ের নিশ্চিন্তি নয়, সঞ্চয়ের রক্ষাকবচও। তাই আজ না হয় দু’দণ্ড সময় হাতে নিয়ে বসুন। স্বাস্থ্য বিমার গোড়ার কথাগুলো অন্তত জানার চেষ্টা করি আমরা।

স্বাস্থ্য বিমা কী?
সহজ করে বললে, এই ব্যবস্থায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিমা সংস্থাকে দেবেন আপনি। আর তার পরিবর্তে আপনার চিকিৎসা খরচের দায় নেবে তারা। ধরুন, এক লক্ষ টাকার বিমার প্রিমিয়াম হিসেবে এক বছরের জন্য দু’হাজার টাকা জমা দিলেন। এ বার সেই জমা দেওয়ার দিন থেকে এক বছরের মধ্যে কোনও দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলে, এক লক্ষ টাকা ‘কভারেজ’ দেবে বিমা সংস্থা। অর্থাৎ, এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ বহন করবে তারা। অসুস্থ না-হলে অবশ্য ওই দু’হাজার টাকা জমা দিয়ে কিচ্ছু পাবেন না আপনি।

এই বিমা কিন্তু বিনিয়োগ নয়
তাই গোড়া থেকেই একটি কথা স্পষ্ট জানা দরকার। তা হল, স্বাস্থ্য বিমা কিন্তু কোনও ভাবেই লগ্নি নয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদের পর আকর্ষণীয় ‘রিটার্ন’ আশা করবেন আপনি।

তা হলে করব কেন?
প্রিমিয়াম দিলেই যে আপনি অসুস্থ হবেন না, তা তো একশো বার সত্যি। কিন্তু অসুস্থতা বা দুর্ঘটনা যে জীবনে ছোবল বসাবে না, সেই নিশ্চয়তাই বা আপনি পাবেন কোথা থেকে? মনে রাখবেন, বিমা সংস্থার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কিন্তু এক বছরের নয়। তাই প্রিমিয়াম হিসেবে মোট যত টাকা সারা জীবনে লগ্নি করবেন, দেখা যাবে হয়তো এক বার বড়সড় অসুখের পরেই আপনার চিকিৎসার প্রাপ্য খরচ দাঁড়াবে তার থেকে বেশি। তা ছাড়া রয়েছে চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের মানসিক অশান্তিকে দূরে সরিয়ে রাখার সুবিধা।

সুবিধার সাত-সতেরো
সাধারণ ভাবে এই বিমা থেকে যে- সবের খরচ পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে—
• হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা
• ওষুধ ও নার্স
• অ্যাম্বুল্যান্স
• অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে (যেমন, কিডনি) অঙ্গদাতার হাসপাতাল খরচ
• পেস মেকার কিংবা হাড় জোড়ার স্টিল প্লেট ইত্যাদির দাম
কিছু সুবিধা এমনি বিমা করলেই পাওয়া যাবে। কিছু ক্ষেত্রে আবার তা আলাদা করে কিনতে হবে ‘রাইডার’ হিসেবে।
একই সঙ্গে জেনে রাখুন, কী কী পাওয়া যাবে না, সে কথাও। যেমন, প্রতিস্থাপনের জন্য অন্য কারও থেকে কিডনি বা কোনও অঙ্গ অর্থের বিনিময়ে নিলে, তার দাম পাবেন না। দাবি করতে পারবেন না চশমা, ক্রাচ, কনট্যাক্ট লেন্স, হুইল চেয়ার, হিয়ারিং এড ইত্যাদির দামও। সাধারণত দাঁতের চিকিৎসারও খরচ জোগায় না কোনও বিমা সংস্থাই। আপনি অফিসের মাধ্যমে ‘গ্রুপ ইনশিওরেন্স’-এর শরিক হলে, অবশ্য এই সমস্ত নিয়ম সব সময় না-ও খাটতে পারে।

করুন কম বয়সেই
বয়স হলে যখন রোগ-জ্বালার প্রবণতা বাড়ে, তখন চিকিৎসা বিমার খোঁজ করেন অনেকেই। কিন্তু আসলে এই বিমা করা উচিত কম বয়সে। যত দ্রুত সম্ভব। কারণ মূলত ৫টি—
() তীব্র প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ আর অনিয়মিত জীবনযাত্রার কারণে এখন কম বয়সেই স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি। যে কারণে চল্লিশ পেরোনোর আগেই বাইপাস সার্জারি কিংবা ডায়াবেটিসের আক্রমণ আজ আর ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।
() পরিবারে সুগার, প্রেসারের মতো অসুখ থাকলে, তা আপনারও হওয়ার সম্ভাবনা। আর এক বার তা হলে, সেগুলি ঢুকে পড়বে ‘প্রি-এক্সিস্টিং ডিজিজ’ (আগে থেকেই যে অসুখ রয়েছে)-এর তালিকায়। ফলে তখন কিন্তু বিমা কিনতে অসুবিধায় পড়বেন আপনি। হয় বেশি প্রিমিয়াম গুণতে হবে। না হলে, অসুবিধার মুখে পড়তে হবে চিকিৎসার টাকা দাবি করার সময়।
কিন্তু বিমা নিয়ন্ত্রক আইআরডিএ-র নিয়ম অনুযায়ী, কোনও গ্রাহক টানা চার বছর প্রিমিয়াম দেওয়ার পরে, তাঁকে সব অসুখের জন্যই ক্লেমের টাকা দিতে বাধ্য বিমা সংস্থা। এমনকী আগে থেকে তা থাকলেও। শর্ত হল, এ ধরনের কোনও অসুখের কথা অবশ্যই সংস্থাকে জানিয়ে রাখতে হবে আপনাকে।
() যত বয়সে বিমা, শুরুর প্রিমিয়ামের অঙ্কও তত বেশি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই প্রিমিয়াম বাড়বে ঠিকই। কিন্তু কম বয়সে করলে, তুলনায় কম টাকায় বাড়িয়ে নিতে পারবেন ‘কভারেজ’ (বছরে যত টাকার স্বাস্থ্য বিমা করতে চান)।
() শুধু অসুস্থতায় তো নয়। এই বিমা টাকা জোগায় দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও। সুতরাং তার প্রয়োজন হতে পারে যে কোনও সময়েই।
() বয়স ৪৫ কিংবা ৫০ পেরোনোর পর বিমা কিনতে চাইলে, আগাম ডাক্তারি পরীক্ষা করতে বলবে অধিকাংশ সংস্থা। কিন্তু অল্প বয়সে বিমা করার পর নিয়মিত নবীকরণ করিয়ে গেলে, সেই ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে পারেন আপনি।

মিলবে করছাড়ের সুযোগও
আয়কর আইনের ৮০ডি ধারা অনুযায়ী, চিকিৎসা বিমার প্রিমিয়াম বাবদ বছরে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করলে, মিলবে কর ছাড়। অতিরিক্ত ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যাবে নির্ভরশীল পিতা-মাতার বিমাতেও। প্রবীণ নাগরিকেরা অবশ্য এই ধারায় ছাড় পেতে পারেন ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

বিমার রকমফের
দু’ধরনের প্রকল্প বাজারে রয়েছে—
এতে নিজের জন্য পলিসি কিনে যুক্ত করে নেওয়া যায় পরিবারের সদস্যদেরও। কিন্তু এখানে সকলের প্রিমিয়াম আলাদা। ‘সাম ইনসিওর্ড’-এর অঙ্কও (যত টাকার বিমা) ধরা থাকে পৃথক পৃথক ভাবে। তবে হ্যাঁ, পরিবারের একাধিক সদস্যকে একসঙ্গে নিয়ে প্রকল্প কিনলে মোট প্রিমিয়ামের উপর ছাড় পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এখানে কিন্তু প্রিমিয়াম আর ‘সাম ইনসিওর্ড’, দুই-ই পরিবারের সকলের জন্য সম্মিলিত ভাবে ঠিক করা।

দু’য়ের ফারাক
ধরুন, আপনার এবং স্ত্রীয়ের ৪ লক্ষ টাকার ফ্লোটার বিমা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বছরের শুরুতে ২ লক্ষ টাকা কারও চিকিৎসার জন্য নেওয়া হলে, পরে বাকি ২ লক্ষ পেতে পারবেন অন্য জন। প্রয়োজনে বিমার পুরো টাকাই এক জনের চিকিৎসার জন্য পাওয়া যাবে। ইন্ডিভিজুয়ালে কিন্তু তা সম্ভব নয়। সেখানে নিজের সাম ইনসিওর্ডের কোটাই আপনার প্রাপ্য।

আগাগোড়া মাথায় রাখুন
• কত টাকার প্রকল্প কিনতে চান। এর জন্য যাচাই করুন বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার খরচ। খেয়াল রাখুন, কতটা স্বাচ্ছন্দ্য আপনি পেতে চান (কোন ধরনের হাসপাতালে কেমন বেড/ কেবিন), সে কথাও।
• পলিসি-র খুঁটিনাটি নিজে পড়ুন। এজেন্টের কথার জাদুতে আত্মসমর্পণ করবেন না।
• মিলিয়ে দেখুন, আস্ত ‘কিট’ হাতে পৌঁছেছে কি না।
• প্রকল্পের সব শর্ত আপনার কাছে স্পষ্ট তো?
• সাধারণত দুর্ঘটনাজনিত কিংবা আপৎকালীন (এমার্জেন্সি) চিকিৎসার খরচ বিমার আওতায় আসে প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু জেনেছেন কি, পাইলস্ কিংবা চোখের ছানি অপারেশনের মতো ‘প্ল্যানড হসপিটালাইজেশনে’ টাকা পেতে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে আপনাকে?
• আপৎকালীন পরিস্থিতি বাদে অন্যান্য চিকিৎসার জন্য পলিসি কেনার পর একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত (অধিকাংশ ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৩০ দিন) চিকিৎসার খরচ দেয় না সংস্থাগুলি। একে বলে ‘কুলিং পিরিয়ড’।
• আজকাল অনেক রোগের চিকিৎসা, এমনকী অস্ত্রোপচারও এক দিনের মধ্যেই হয়ে যায়। দেখে নিন, এই ‘ডে কেয়ার’-এর খরচও আপনার বিমা সংস্থা বইবে কি না।
• আগে থেকেই যে সব রোগ আপনার রয়েছে (প্রি-এক্সিস্টিং ডিজিজ), তার জন্যও বিমার সুরক্ষা আপনি পাবেন কি না?
• মনে রাখবেন, পলিসি করার সময়ই এই সব রোগের কথা সংস্থাকে স্পষ্ট করে জানানো জরুরি। কারণ, বিমার দাবি (ক্লেম) পাওয়ার সিংহ-ভাগ সমস্যাই তৈরি হয় একে ঘিরে।
• হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা করার আগেই দেখে নিন ডাক্তার, দৈনিক বেড ভাড়া ইত্যাদি খাতে সর্বোচ্চ কত টাকা পেতে পারেন।
• হাতের কাছে রাখুন বিমা সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া থাকা হাসপাতালের তালিকা।
• আগে থেকেই জেনে রাখুন, ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসার খরচ বা ‘ক্লেমের পর’ বিমার টাকা পেতে কার সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ করতে হবে আপনাকে। জেনে নিন, তখন জমা দিতে হবে, এমন নথিপত্রের খুঁটিনাটিও।
• একাধিক স্বাস্থ্য বিমা থাকলে (এমনকী অফিস প্রিমিয়াম দিলেও), তা সংস্থাকে জানিয়ে রাখুন।
• বিমা সংস্থার কাছে থেকে কি ‘ক্যাশ লেস’ পরিষেবা পাচ্ছেন আপনি?
• অবশ্যই জানুন, আপনার বিমা সংস্থাটি ক্যাশলেস পরিষেবা সরাসরি দেয়? না কি ‘টিপিএ’ ব্যবস্থার মাধ্যমে। তার পর নিজের পছন্দ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিন।

মণিকা দত্ত


• বিমা সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ সরাসরি নিজে জানান। পরিবারের লোকেদের সাহায্য নিতে পারেন। উকিলের সাহায্য নিলে তা গ্রাহ্য করা হয় না। বিমা সংস্থা বা এজেন্ট মারফত এলেও তা মানা হয় না।
• বিমার মূল্য ২০ লক্ষ টাকার বেশি হলে লোকপাল সাহায্য করে না।
• সাদা কাগজে চিঠি লিখে ড্রপ বক্সে ফেললেই হয়। অথবা পাঠাতে পারেন ফ্যাক্স। এ জন্য কোনও টাকা দিতে হয় না।
• প্রথম অভিযোগ জানান নিজের বিমা সংস্থার কাছে। প্রতিটি সংস্থারই নিজস্ব গ্রাহক পরিষেবা ও অভিযোগ কেন্দ্র রয়েছে।
• সংস্থার কাছ থেকে এক মাসের মধ্যে উত্তর না-পেলে অথবা উত্তর মনের মতো না-হলে লোকপালের কাছে যান।
• বিমা সংস্থায় অভিযোগ জানানোর প্রমাণ রাখুন নিজের কাছে।
তা টোকেন নম্বর (যদি ফোন মারফত জানান) অথবা লিখিত চিঠিও হতে পারে।
• লোকপালের পক্ষ থেকে তিন মাসের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবে লাগতে পারে বেশি সময়ও।

মূলত চারটি বিষয়ে লোকপাল সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
১) সংস্থা বিমা মূল্যের পুরোটা বা আংশিক দিতে অস্বীকার করলে।
২) বিমার মূল্য দিতে দেরি হলে।
৩) প্রিমিয়াম দিয়েছেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজ হাতে পাননি।
৪) প্রিমিয়াম নিয়ে কোনও অভিযোগ (ভুল বোঝানো ইত্যাদি)।
• কোনও ধরনের জালিয়াতি, নথিতে ভুল, এজেন্ট অথবা থার্ড পার্টি (টিপিএ)-র বিরুদ্ধে অভিযোগ লোকপালের আওতার বাইরে।
• কলকাতা বিমা লোকপালের অধীনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, সিকিম এবং আন্দামান ও নিকোবর।


অভিযোগ জানানোর ঠিকানা:
অফিস অফ দ্য ইনশিওরেন্স ওম্বাডসম্যান, কলকাতা
হিন্দুস্তান বিল্ডিং অ্যানেক্স
৪, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, চতুর্থ তল
কলকাতা- ৭০০০৭২


ফোন নম্বর: (০৩৩) ২২১২-৪৩৪০
ফ্যাক্স: (০৩৩) ২২১২-৪৩৪১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.