স্রেফ চাওমিন-চিলিচিকেনে নয়, দীপাবলির আলোতেও চিন। একদা সাবেক মাটির প্রদীপের জায়গা নিয়েছিল মোমবাতি। সময়ের ফেরে সেই মসনদে এখন নয়া দখলদার।
আলোর উৎসবকে নিশানা করেই কলকাতার বিভিন্ন বাজারে ঢুকে পড়েছে চিনা আলোর সম্ভার। একঘেঁয়ে মোটাসোটা টুনিবাল্বের বদলে পুঁতির মালার মতো রংবেরঙের টুনি (রাইসবাল্ব)। প্লাস্টিকের জবাফুল বা অপরাজিতার ভিতরেও টুনির শোভা। সাবেক পিদিম-মোমবাতির আদল ধরে রেখেও লুকোনো টুনিতে আলো জ্বালছে চিন। পাশাপাশি রয়েছে এলইডি আলোর রমরমাও। এ দিকে, প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে না পেরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে রাজ্যের সাবেক টুনিবাল্ব কারখানাগুলির। আলো ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেলেঘাটা-এন্টালির যে আলো এক সময় বাজার কাঁপাত, চিনা ‘আগ্রাসনের’ কাছে তাঁরা ইতিমধ্যেই কয়েক গোল খেয়ে বসে রয়েছে।
দুর্গাপুজোর পর থেকেই চাঁদনি চক, এজরা স্ট্রিটের মতো বাজারগুলি ভরে গিয়েছিল চিনাপ্রযুক্তির আলোয়। গত কয়েক বছরে এমনটাই দস্তুর। চিনা মোমবাতি বা প্রদীপের দাম কত? বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এমন আলোর দাম চেন প্রতি ২০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে। যেখানে স্থানীয় বাজারের আলোর দাম এর দ্বিগুণ। ফলে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ক্রেতারা ঝুঁকছেন নতুন আলোর দিকেই। একটু চড়া দামের সুদৃশ্য ‘লেজার’ আলোর কদরও ক্রমশই বাড়ছে। |
মঙ্গলবার, দীপাবলির বিকেলেও খদ্দের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন চাঁদনি চকের ফয়জল আহমেদ। ৩০-৪০ টাকায় যে চিনা আলো মিলছে, স্থানীয় বাজারে তৈরি সেই আলোরই দাম পড়ছে ৮০ টাকার কাছাকাছি। ফয়জল বললেন, “এখানে নকশাদার টুনি তৈরির খরচও বেশি। ফলে চিনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না কলকাতা।” এজরা স্ট্রিটের ভিড় ঠেলে আলো নিয়ে দিগ্বিজয়ীর ভঙ্গিতে বেরিয়ে এলেন দিলীপ ঘোষ। “বাড়িতে পুজো। কয়েকটা ‘চেন’ কম পড়েছিল। ৩০ টাকা দরে বেশ কয়েকটা টুনি-সেট কিনে নিলাম।”
শুধু আমগেরস্তের পকেটের জন্য নয়, চাহিদা পাল্টেছে পুজোর আলোকসজ্জার কারণেও। রাস্তায় টিউবলাইট বা বাল্বের আলো এখন আর দেখা যায় না। তার বদলে পুজোর সময় শহরের রাস্তা দখল করেছে ছোট টুনি বা এলইডি। আলোকশিল্পীরা বলছেন, এই ধরনের আলো লাগাতে অনেক কম খরচ পড়ে। দেখতেও সুন্দর। ফলে পুজো কমিটিগুলির কাছেও পুরনো আলোকসজ্জা এখন বাতিল। এই আলোয় বিদ্যুতেরও সাশ্রয় হয় বলে দাবি করেছেন অপ্রচলিত শক্তি বিশেষজ্ঞ শান্তিপদ গণচৌধুরী। তিনি বলেন, “এলইডি বা রাইস বাল্বের আলো দেখতে সুন্দর হলেও জোরালো নয়। ফলে এতে বিদ্যুৎও কম লাগে।”
রাজ্যে কী ভাবে ঢুকছে চিনা আলো? ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আট-দশ জন বড় ব্যবসায়ী মিলে উৎসবের কয়েক মাস আগেই চিনের বিভিন্ন কারখানায় বরাত দিচ্ছেন। তার পর সে দেশ থেকে জাহাজে চাপিয়ে তা পাঠানো হচ্ছে রাজ্যে। শুধু আলোই নয়, বিকোচ্ছে চিনা মোমও। একেই টুনির রমরমায় পিছিয়ে পড়েছিল রাজ্যের মোমশিল্প। ‘চিনা-হামলায়’ কার্যত নাভিশ্বাস উঠেছে তাঁদের। মোমবাতি প্রস্তুতকারকদের সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়াক্স বেস্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সমীর দে জানিয়েছেন চিনা মোমবাতির ত্রাসের কথাও। তাঁর দাবি, “চিনে মোমবাতি তৈরির কাঁচামালের দাম অনেক কম। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে যেমন নকশাদার মোমবাতি তৈরি হচ্ছে, তার কাছেও পেরে উঠছি না।’’ বছর তিনেক আগেও যেখানে দীপাবলীর মরসুমে মাঝারি কারখানায় ৪০-৫০ টন মোমবাতি তৈরি হত, এখন তা কমে ২০-২৫ টনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানালেন সমীরবাবু। |
চিনের এই ধরনের শিল্পের সঙ্গে পেরে ওঠা যে দুঃসাধ্য, তা স্বীকার করে নিয়েছে শিল্পমহলও। ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স’-এর প্রাক্তন সভাপতি সমীর ঘোষের কথায়, “চিনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানাগুলির যে বিপুল পরিমাণ উৎপাদন ক্ষমতা, তা আমাদের রাজ্যে কল্পনা করা যায় না। এ ধরনের শিল্পে চিনে যেমন সরকারি ভর্তুকি ও গবেষণানির্ভর সাহায্য মেলে, তা এখানে মেলে না।” ফলে আলোর যুদ্ধে আগামী দিনেও চিনের দাপট নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তাঁর।
|