সেই হলদিয়া, সেই শুভেন্দু।
তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে নিজের শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে শুরু করেছিল, শিল্পমেলা বেঙ্গল লিডস। গত বছর কলকাতায় তার আয়োজন হয়েছিল। মাসখানেক আগে হলদিয়া বন্দরে এবিজিকে নিয়ে অশান্তির আবহেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দেন, এ বারে বেঙ্গল লিডস-২ হবে হলদিয়াতেই। মঙ্গলবার শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হলদিয়ায় এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই সময়সূচি ঘোষণা করে গেলেন।
হলদিয়ায় এবিজি-বিতাড়নকে কেন্দ্র করে রাজ্যের ভাবমূর্তি এমনিতেই আর এক প্রস্ত ধাক্কা খেয়েছে। সেই সময় হলদিয়াতেই বেঙ্গল লিডস-এর আসর বসিয়ে ইতিবাচক বার্তা দিতে মরিয়া সরকার। কিন্তু শিল্প মহলকে এ দিন বিস্মিত করেছে শিল্পমেলার একটি বৃহৎ দায়িত্বে শুভেন্দু অধিকারীর মনোনয়ন, যে শুভেন্দু কিনা হলদিয়ার সাম্প্রতিক অশান্তির পিছনে অন্যতম মাথা বলে অভিযোগ। প্রশ্ন উঠেছে এবিজি-কাণ্ডে শুভেন্দুর ভূমিকা নিয়ে যখন এত সমালোচনা, তখন তাঁকে এই গুরুদায়িত্ব দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে কী বার্তা পাঠাচ্ছে রাজ্য সরকার?
ঘটনা হল, শিল্পমন্ত্রী এ দিন দু’টি বিষয়ই জানিয়েছেন মাত্র। প্রথমত, আগামী ১৭ জানুয়ারি থেকে হলদিয়ার হেলিপ্যাড ময়দানে শুরু হবে বেঙ্গল লিডস-২। দ্বিতীয়ত, অনুষ্ঠানের দু’টি ভাগের (মূল মেলা ও প্রদর্শনী) মধ্যে একটির দায়িত্ব (প্রদর্শনী) সামলাবেন হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের (এইচডিএ) চেয়ারম্যান, তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। এই দু’টি তথ্য ছাড়া কার্যত আর কিছুই এ দিন বলতে পারেননি শিল্পমন্ত্রী। না সম্ভাব্য অতিথিদের তালিকা, না অনুষ্ঠানের রূপরেখা। যদিও এই ধরনের অনুষ্ঠানের ঘোষণার সময়েই সাধারণত একটা রূপরেখা জানিয়ে দেওয়া হয়। সময় চেয়ে রাখা হয় শিল্প-কর্তাদেরও। কারা কারা আসতে চলেছেন, থাকে তার একটা সম্ভাব্য তালিকাও। এ দিন সে সবের কিছুই নেই। প্রথম থেকেই আয়োজনের ঢিলেঢালা ভাবটা স্পষ্ট। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পার্থবাবু শুধু জানান, ‘বেঙ্গল লিডস-২’ হবে দু’টি পর্যায়ে মূল মেলা ও প্রদর্শনী। মেলা তিন দিন চলবে। প্রদর্শনী কত দিন চলবে, তা জানাতে পারেননি মন্ত্রী। কারা আসবেন মেলায়? শিল্পমন্ত্রী বলেন, “বাংলা ও বাইরের শিল্প সংস্থার কর্তাদের আমরা মেলায় যোগ দিতে আবেদন জানাব।” |
এ বার হলদিয়ায় কেন? শিল্পমেলার প্রস্তুতি বৈঠক শেষে পার্থবাবুর বক্তব্য, “আমরা দেখেছি পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, খড়্গপুরে বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক রয়েছে। হলদিয়া এই সব এলাকা থেকে বিশেষ দূরে নয়। তাই লগ্নিকারীদের এখানে আনতে চাই। মাত্র দু’ঘণ্টায় কলকাতা থেকে হলদিয়ায় পৌঁছনো যায়।” শুভেন্দুকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া হল কেন? “শুভেন্দু এইচডিএ-এর চেয়ারম্যান। তবে ওই শিল্পমেলার মূল উদ্যোক্তা শিল্প দফতর। তা যৌথ ভাবে কার্যকর করবে এইচডিএ এবং রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম।”
দুয়ে মিলে একটা বার্তাই স্পষ্ট বলে মনে করছে শিল্প মহল।
সেটা কী?
বন্দরে পণ্য খালাসকারী সংস্থা এবিজি হলদিয়া ছাড়ার পরে কাজ হারানো শ্রমিকেরা গোটা ঘটনার জন্য শুভেন্দুর দিকে আঙুল তুলেছিলেন। রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। সেই সময় খোদ মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রী এবং অবশ্যই শুভেন্দু বারবার বলেছিলেন, বন্দরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এবিজি বিদায়ে হায়-হায় রব আসলে একটি সংবাদ-গোষ্ঠীর প্রচার।
এ দিন তাঁরা নিজেদের সেই অবস্থানটাকেই আরও এক বার তুলে ধরতে চাইলেন। শুভেন্দুকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া থেকে ‘বেঙ্গল লিডস্-২’-এ প্রদর্শনী বিভাগের দায়িত্ব শুভেন্দুকে দেওয়া সবেতেই মিলেছে সেই ইঙ্গিত। পার্থবাবুর কথায়, “এইচডিএ ও শুভেন্দুকে সামনে রেখেই অনুষ্ঠানের রূপরেখা তৈরি হবে। স্থানীয় বণিক মহল ও শিল্পসংস্থাও তাতে থাকবে।”
এ দিনের বৈঠকে স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন শিল্পসংস্থার প্রতিনিধি ছাড়া সিআইআই, বেঙ্গল চেম্বার ও অ্যাসোচ্যামের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সিআইআই-এর রিজিওনাল ডিরেক্টর সৌগত মুখোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, “আশা করি, আগামীতে হলদিয়ার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হবে। আমরা সব রকম সহযোগিতা করব।” কিন্তু ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স-সহ রাজ্যের অন্য বণিকসভাগুলি এ দিনের বৈঠক নিয়ে অন্ধকারে ছিল। কেউ কেউ নিজে থেকে এইচডিএ ও নিগমের সঙ্গে সোমবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সাড়া মেলেনি বলে দাবি। শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্য, এটা প্রাথমিক বৈঠক। শিল্প-সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকেই সবাইকে সব কিছু জানানো হবে। তাঁর কথায়, “আগেও সকলকে নিয়েই চলেছি। ভবিষ্যতেও তা-ই হবে।”
কিন্তু শিল্প মহলের দুশ্চিন্তা বেড়েছে বই কমেনি। বস্তুত রাজ্য সরকার লগ্নি টানতে ঠিক কতটা উদ্যোগী, তা নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েছেই। সিঙ্গুর আন্দোলনের পরে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিটি পদক্ষেপ গভীর ভাবে লক্ষ করে চলেছেন তাঁরা। এবিজি-কাণ্ড তাঁদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যেমন ঢিলেঢালা ভাবে শিল্পমেলার ঘোষণা করে দেওয়া হল, শুভেন্দুকে যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হল, তা দেখে রাজ্যের ভাবমূর্তি ও লগ্নির সম্ভাবনা নিয়ে আরও গভীর সংশয়ে তাঁরা। এক শিল্প-কর্তা বলেই ফেললেন, ‘গড সেভ বেঙ্গল!’ |