স্মরণ ৩...
চিনি-তর্পণেই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ
মার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে! সুনীলের সঙ্গে পরিচয় কবিতায়। সশরীরে আলাপ কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। যাদবপুরে এম এ পড়তে ঢুকেছি, আঠারো উনিশ বছর বয়স, দীপক মজুমদার আর প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, দুই কবি বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলুম প্রথম দিন কফি হাউসে। আমি স্বভাবচঞ্চল, টেবিলে চৌকো চৌকো চিনির কিউব দেখে খুব খুশি হয়ে দুই হাতে মুঠো ভর্তি করে চিনিগুলো ধরেছি, এমন সময়ে দু’টি ছেলে এসে আমাদের টেবিলে বসল। দীপক আলাপ করিয়ে দিল, সুনীল, শক্তি। তখন আলাপ করলে নমস্কার করার চল ছিল। হাত তো বোঝাই চিনিতে। আমার হাতের চিনিগুলো সামনে বসা সুনীলের অঞ্জলিতে অর্পণ করে, হাত ফাঁকা করে নিয়ে তাদের নমস্কার করলুম। এ দিকে সুনীলের দুই হাত তখন চিনিতে ভর্তি, সে বেচারি কেমন করে প্রতিনমস্কার করবে? যথাস্থানে চিনি প্রত্যর্পণ করে আমাদের আলাপসালাপ হল!
সুনীল আর আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না, আর তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না, ফোন করলে উলটো দিকে তাঁর গলার স্বর শুনতে পাব না, এ কঠোর সত্য সহজে সহ্য হবার নয়। একটি মেয়ে আমায় লিখেছে, “আমি প্রেম করতে শিখেছি সুনীলের কাছে, যদিও কোনও দিন সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি, তাঁর কবিতাই আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছে।” আর এক তরুণ কবি মর্মাহত হয়ে ফোনে বললেন, “আমরা প্রেম করতুম সুনীলের কবিতার লাইন তুলে দিয়ে দিয়ে, পরস্পরের সঙ্গে চিঠি লেখালেখি চলত এ ভাবেই, সুনীলের মাধ্যমে সব কথাই বলেছি।”
ঠিক আমাদের অল্প বয়সে আমরা যা করেছি রবীন্দ্রনাথের লাইন নিয়ে।
শুধু কি ছোটরাই? কেন, আমরা নই? সমসাময়িক হলেই বা? আমরা পদে পদে শঙ্খ, সুনীল, শক্তির আশ্রয় নিই না? এবং এখন তো জয়েরও।
ভাল কবিরা আমাদের মনের কথাগুলো আমাদের চেয়ে অনেক ভাল করে বলতে পারেন, যেমন বলে গিয়েছেন সুনীল। সুনীল যে কী ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন আমাদের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকায়, তা কি তিনি পুরোপুরি জেনে যেতে পেরেছেন?

‘যাত্রা ফুরোয়নি।’ নবনীতা দেব সেন ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীলের সঙ্গে আলাপের আগে তাঁর সম্পর্কে মোটেই ভাল ধারণা ছিল না আমাদের মতো গুড গার্লদের। ছেলেটা ভাল কবি হলে কী হবে, দারুণ মাতাল, মাতাল মানেই অসচ্চরিত্র! পঞ্চাশের কবিদের সঙ্গে আলাপ হবার পরে দেখা গেল, হ্যাঁ সুরাপানে মত্ততা ঘটে বটে, এবং সেটা ভাল নয়, কিন্তু মাতাল মানেই অসচ্চরিত্র নয়। সত্তরের গোড়ার দিক। বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের মেলা বসত ময়দানে। আমি আমার বাচ্চা মেয়েদের নিয়ে মেলায় গিয়েছি, সঙ্গে কলেজ জীবনের বন্ধু, ষাটের কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়। কৃত্তিবাসের তাঁবুতে পৌঁছে দেখি কবিতা পড়াটড়া শেষ, দোকানের পিছনের পর্দার ও পারে পানসভা বসেছে। শক্তিকে মাটি থেকে তোলা যাচ্ছে না। শরৎবাবু সেখানে নেই। সুনীল আছেন। কিন্তু পায়ের ভিতরে পা। আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চেষ্টা করি। সে যত্রতত্র মাটির ওপর বসে পড়ছে। আমার হঠাৎ কী মনে হল, আমার এক মেয়েকে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললুম, “এই ভিড়ের মধ্যে দু’জনকে নিয়ে চলতে পারছি না, তুমি ওকে নিয়ে চলো তো একটু গেটের দিকে।” শুনে সুনীল টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল, মেয়েটার আঙুল ধরে মিষ্টি করে বলল, “চলো ভাই, আমরা দু’জনে বাড়ি যাই”, বলে দিব্যি টলে টলে হেঁটে হেঁটে গেটের দিকে চলল। এক সময়ে ভিড়ের মধ্যে ওদের আর দেখা গেল না। যত খুঁজে পাই না, তত বিজু আমাকে বকে। “কে মাতাল? তুই না সুনীল? মাতালের হাতে কেউ বাচ্চা তুলে দেয় এই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে? কী হবে এখন?”
আমি মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকছি। গেটে পৌঁছে দেখি অতিকায় এক বেলুন হাতে আমার এক কুচি কন্যা, আর হাস্যবদন সুনীল দণ্ডায়মান। মেয়ে বলল, “মা, এই দ্যাখো সুনীলমামা দিয়েছেন, আমার হাতে মনুমেন্ট!” বিজয়ার কাছে আমার দারুণ মুখরক্ষা হয়েছিল সে দিন। মেলার মধ্যে কেমন যেন মনে হয়েছিল বিশ্বাস করে জরুরি কোনও দায়িত্ব অর্পণ করলে, মাতাল হোক আর যা-ই হোক, সুনীল পালন করবেই। জোর করে ঠিক করে নেবে নিজেকে। নিয়েছিলও। আমরা ফিরলাম মহানন্দে। আমি চালক, আমার পাশে সুনীল গলা ছেড়ে গান গাইছেন, পিছনে বিজু গাইছে, জানালায় পতাকার মতো উড়ছে মনুমেন্ট।
আমার লিখতে গুরুতর সমস্যা হচ্ছে, সুনীলকে ‘সে’ লিখব না ‘তিনি’ লিখব? প্রয়াত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির প্রসঙ্গে ‘সে’ লিখলে রূঢ় শোনায়, আর বন্ধু সুনীলের প্রসঙ্গে ‘তিনি’ লিখলে বড্ড দূরের শোনায়। বন্ধু সুনীল তো আমার শ্রদ্ধেয় কবিও বটেন? বাংলা কবিতার যৌবনে তিনিই স্পর্ধা এনে দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে এত উন্মুক্ত ভাবে অথচ এত মোহিনী রূপে ব্যবহার করে গিয়েছেন। অনেক শত্রু বানিয়েছেন তিনি, বাগদেবীর প্রতি তাঁর কৈশোরের কাম নিয়ে একটা গল্প বলে। কিন্তু বাংলা ভাষার সঙ্গেও তো তাঁর তেমনই কামনা ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক। তাঁর কবিতার প্রতিটি লাইন, শব্দ, অক্ষর, তার কমা, ড্যাশ, রেফ ও র-এর ফুটকি সমেত ছুটে গিয়েছে— গুণিনের বাণের মতো ছুটে গিয়েছে, ভবিষ্যতের কবিদের দিকে! তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন কী অনায়াসে, কবিতার ভাষার সম্মানের হানি না ঘটিয়েই লিখতে পারা যায় ‘যোনির ভিতর জিভ’-এর প্রসঙ্গও, যখন তা ‘লবণাক্ত স্বাদ ছাড়া কিছুই আনে না!’ শিল্পের মান বজায় রেখে ভাষা ব্যবহারে দুঃসাহস দেখানো সহজ নয়, খুব সূক্ষ্ম এক লক্ষ্মণরেখা আছে শ্লীল ও অশ্লীলের মাঝখানে। সেটি পেরিয়ে গেলেই শিল্পের বেড়া পেরিয়ে যেতে হয়। হাংরি জেনারেশনের কবিতায় অনেক সময়ে এই রেখাটি ঠিক থাকেনি। অনেক শিখেছে পরের প্রজন্ম সুনীলের কবিতার কাছে। পরবর্তী কবিদের বেশির ভাগই লেখার ব্যাপারে সে ভাবে শক্তির নয়, যে ভাবে সুনীলের শিষ্য। ভাষার ব্যবহারে সুনীল অনেক স্বচ্ছ, সহজ, তাঁর মতো করে নিজের কথা লিখতে পারা যায়। এই কারণেই হয়তো সুনীলের অনুগামীর সংখ্যা অগুন্তি।
আশ্চর্য হয়ে ভাবি, শুধু সাহিত্যের বিভিন্ন বিচিত্র শাখায় নয়, গ্রন্থের সংখ্যাতেও সুনীলের সঙ্গে আর কারও লেখার কোনও হিসেব হয় না। সুনীল কবি হিসেবে আমার কাছে খুব জরুরি, তার পরে তাঁর গদ্য এসেছে। কবিতার ক্ষেত্রে আমি যদি একটাও কবিতা লিখতে পারি যা দিয়ে মানুষের আমার কথা মনে পড়বে, আর গদ্যের ক্ষেত্রে এক জীবনে আমি যদি একটা ক্লাসিক গ্রন্থ রচনা করতে পারি তা হলেই আমি আমার জীবন ধন্য বলে মনে করব। সুনীল অনন্ত অবিস্মরণীয় কবিতা, আর অন্তত দু’টি অনন্যসাধারণ ধ্রুপদী উপন্যাস লিখেছেন, ‘প্রথম আলো’ আর ‘সেই সময়’। আর সেই সাতাশ বছরের ছেলেটা, যার পায়ের তলায় সর্ষে, সেই নীললোহিতকেই কি ভুলতে পারবে বাঙালি পড়ুয়া?
আমার প্রথম উপন্যাসের বায়না এল শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে, ১৯৭৬’এ। সুনীলের উপন্যাস বেরিয়ে গিয়েছে দশ বছর আগে। আমি খসড়া লিখছি, আর ভাবছি শুরুটা করি কেমন করে? শেষে সুনীলকে জিজ্ঞেস করি কী করব। সুনীল বলল, ‘শুরু করবে কোনও অ্যাকশনের মাঝখানে। যথা, ‘সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে নেমে আসছিল রুমনি। বা কোনও ডায়লগ দিয়ে।’ কোনটা করেছিলুম এখন মনে পড়ছে না, তবে সুনীলের উপদেশ বেদবাক্যের মতো মনে হয়েছিল।
সুনীল আর আমি জীবনের অনেক মূল্যবান মুহূর্ত এক সঙ্গে কাটিয়েছি। অনেক বার দেশে-বিদেশে একত্রে কবিতা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। নিউ ইয়র্কে এক দিন মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট-এ, আর এক দিন সেন্ট্রাল পার্কের ব্যান্ডস্ট্যান্ডে কবিতাপাঠ ছিল। সুনীলের বন্ধু বিট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘ভারত উৎসব’-এর কবিতাপাঠ উদ্বোধন করেছিলেন, ছোট্ট হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গেয়ে নিজের কবিতা শুনিয়ে। ভারতের অনেকগুলি অঞ্চল থেকে কবিরা গিয়েছিলেন। প্রতি দিন ডিনারে আমাদের সকলকে মার্কিন কবিরাই কেউ না কেউ খাওয়াতেন। কিন্তু আমরা ভারতীয় দল থেকে, সরকারি খরচ হলেও, কেন জানি না প্রাণে ধরে তাঁদের খাওয়াতুম না। শেষ দিন সুনীল আর লজ্জা সইতে না পেরে নিজের খরচে তাঁদের সবাইকে পানভোজনে আপ্যায়িত করলেন, ভারতবর্ষের হয়ে। আমার খুব গর্ব হল। সুনীলের তো অন্যদের চেয়ে অর্থ বেশি ছিল না, মনটা ধনী ছিল।
এক বার ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে বসে প্রতীক্ষা করছি কলকাতার প্লেনের জন্য। হঠাৎ পিছন দিক থেকে একটি উপবিষ্ট মানুষের মাথা দেখে মনে হল, সুনীল না? অমনি দৌড়ে গিয়ে ‘সুনীল’ বলে চেঁচাতেই দেখি, ঠিক!! সুনীল চিন থেকে আর আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরছিলুম। মাঝরাস্তায় পৌঁছে বসে আছি কলকাতার প্লেন ধরতে। সেইখানেই আমাদের সঙ্গে ভাব হয়ে গেল এক বাঙালি ডাক্তারের। তিনি সান্টা লুসিয়াতে থাকেন, মহোৎসাহে নেমন্তন্ন করলেন আমাদের দু’জনকেই সেই ছোট্ট সুন্দর দ্বীপে বেড়াতে যেতে। যাওয়া হয়নি। সে বারে দুই বন্ধু দুই জায়গা থেকে রওনা হয়ে, একসঙ্গে কলকাতায় ফিরেছিলুম। দমদমে স্বাতী তো আমাকে দেখে অবাক!
যাত্রা ফুরোয়নি। আবার কোনও সুন্দর ছোট্ট দ্বীপে দেখা হয়ে যাবে আমাদের। দু’জনে দু’জায়গা থেকে রওনা হয়ে এক স্টেশনেই নামব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.