তিলাবনি পাহাড়ের ঢালে কাশ ফুটলেই কলাবনি বোঝে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ার সময় এসেছে। তার মানেই ঘরের বাইরে এ বার পা ফেলার ডাক এল। ধুনুচি নাচের সঙ্গে ঢাকের সেই চেনা বোল ফুটিয়ে তুলতে হবে-- ঠাকুর থাকবে কত ক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। এ ভাবেই প্রতি বছর ঢাকিদের গ্রাম হুড়ার কলাবনিতে প্রকৃতি পুজোর বার্তা পাঠায়।
পুজোর কয়েক সপ্তাহ আগে এখন তাই কলাবনির কালিন্দী পাড়ায় তুমুল ব্যস্ততা। কারও বায়না হয়েছে পুরুলিয়া শহরে, কারওবা ডাক এসেছে রেলশহর আদ্রা থেকে। কাশীপুর, রঘুনাথপুর থেকে পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি বা অন্য শহরেও অনেকে ঢাক বাজাতে যাবেন। এখন তাই দলবেঁধে তাঁরা ঢাক বাজানোর মহড়া দিচ্ছেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কালিন্দী পাড়ায় বাজছে ঢ্যাম কুড়াকুড়।
বাপ-ঠাকুরদার সময় থেকে গিরিধারী কালিন্দীরা পুজোয় কাশীপুরে ঢাক বাজাতে যান। এ বারও সেখান থেকেই ডাক পেয়েছেন। অর্জুন কালিন্দীর বায়না হয়েছে আদ্রার রিটায়ার্ড কলোনিতে। দীপক কালিন্দীকে অবশ্য যেতে হবে রাঁচি। |
২২-২৩ ঘর ঢাকিদের কেউই বোধহয় ফাঁকা নেই। পুজোর দু’দিন আগেই তাঁরা কাঁধে ঢাক ঝুলিয়ে মণ্ডপে রওনা দেবেন। প্রতিবারই তাই হয়। তবুও সপ্তমীর ভোরে দূরে দ্বারকেশ্বরে যখন কলাবউ স্নান করাতে আসা ঢাকিদের বাজনা শোনা যায়, তখন কলাবনির কালিন্দী পাড়ায় ঢাকিদের ঘরের লোকেদের মন ভার হয়ে থাকে। কালিন্দীপাড়ার বধূ শেফালি কালিন্দীর কথায়, “ঘরের পুরুষ বাড়ির বাইরে। শুধু বয়ষ্ক ও ছোটদের সঙ্গে মেয়ে-বউরা ঘরে থাকি। গ্রামে একটা দুর্গাপুজো হয়। ছেলেপুলেরা জেদ ধরলে গ্রামেই ঠাকুর দেখিয়ে আনি। ভাল খাবারের কথাও ভাবতে পারি না। পুজোয় আর আমাদের আনন্দ কী?” পরিবার-পরিজন ছেড়ে দূর দেশে পুজো মণ্ডপে ঢাক বাজাতে ঢাকিদেরই কি আর ভাল লাগে! সঞ্জিত কালিন্দী, নেপাল কালিন্দীরা বলেন, “ঢাক বাজাতে বাজাতে মাঝে মধ্যে বাড়ির জন্য মন খারাপ করে। ছেলেমেয়েগুলো কী খাচ্ছে, মণ্ডপে কেউ ঠাকুর দেখাতে ওদের নিয়ে গেল কি-- এমনই নানা চিন্তা মাথায় আসে।”
তবে ঢাকি পরিবারের সবাই জানেন, বিসর্জনের বাজনাতেই তাঁদের কাছে সুখের আবাহন হয়। শেফালি কালিন্দী, সনকা কালিন্দীরা বলেন, ‘‘একাদশীর পরে স্বামী ফিরে এলে আমাদের বাড়িতে আনন্দ ফেরে। ওদের রোজগারের টাকায় কিছু ভাল খাবার আসে। নতুন পোশাকও আসে।” এ ভাবেই ওঁরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। যেমন, শেফালিদেবী বলছিলেন, “২০ বছর স্বামীর ঘর করছি। কোনও বছর স্বামীর সঙ্গে পুজোর মণ্ডপে ঘুরেছি, মনে পড়ছে না।” আসলে ওই স্বপ্নটা তাঁরা দেখতেও চান না। কারণ, পুজোর দিনগুলোয় ঢাক বাজিয়েই যেটুকু তাঁদের রোজগার। দুর্গা এলে তাঁরা লক্ষ্মীর মুখ দেখেন। বছরের বাকি সময় তো সেই বাঁশের ঝুড়ি, কুলো, ধামা ইত্যাদি তৈরি করে গ্রামের হাটে বিক্রি করে সামান্য আয় হয়।
অর্জুন কালিন্দী, তারাপদ কালিন্দীরা বলছিলেন, “বছরভর আমাদের অভাবের সংসার। চাষের জমি নেই। বাঁশ কিনে গেরস্থালি জিনিসপত্র তৈরি করে যা দাম মেলে, তাতে চাল, নুন জোগাড় করাই দায়।” কিন্তু পুজোর ঢাক বাজানোর সুদিনও কত দিন থাকে তা নিয়ে সংশয়ে ঢাকিদের গ্রাম। কারণ, এখান বাজারে ঢুঁ মারলেই ঢাকের বাদ্যির সিডি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে খরচ কমাতে পুজো কিছু কিছু উদ্যোক্ত ঢাকিদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তাই ওই চকচক চাক্কিই যেন বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে ঢাকিদের। চেনা মণ্ডপগুলো থেকে ডাক আসায় এ বছরের মতো ভয়টা কেটে গিয়েছে।
ঢাকিরা তাই ঢাকের উপর খুশি মনেই কাটি মারছেন। পুজোর মুখে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ঢাকিরা ছেলেপুলেদের প্রতিবারের মতো এ বারও বলবেন, “ক’টা দিন সবুর কর। শহরে ঢাক বাজিয়ে ফেরার সময় তোর জন্য জামা কিনব, মিষ্টি আনব।” |