তিনি না থেকেও আছেন। ছায়ার মতো।
গ্রামের দিনমজুর থেকে চাষি, চাকরিজীবী থেকে ব্যবসায়ী সবার ঘুরে ফিরে তিনিই নির্বাচনের মধ্যমনি।
প্রণব মুখোপাধ্যায়। মাস তিনেক আগেও তিনি ছিলেন জঙ্গিপুরের সাংসদ। কেউ ডেকেছেন ‘প্রণবদা’, কেউ বা ‘কাকু’। দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে সে সবের উর্দ্ধে তিনি। প্রোটোকলের ঘেরাটোপে পড়ে ফোনও ধরতে পারেন না। প্রণববাবু না থাকলেও জঙ্গিপুর লোকসভা উপনির্বাচনে তিনি পরোক্ষে সবসময়ই রয়েছেন।
সুতি বিধানসভা এলাকায় দলীয় নির্বাচনী পর্যবেক্ষক কংগ্রেসের আলফাজুদ্দিন বিশ্বাস বলেন, “যেখানেই যাই ঘুরে ফিরে আসে প্রণববাবুর কথা। নাজিরপুর ও বহুতালির মানুষ প্রণববাবুর কথা বলতেই বললেন উনি ছিলেন বলেই না রাস্তা পাকা হল। ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তার শিলান্যাস হয়েছিল ৪২ বছর আগে। প্রণববাবু সাংসদ হয়ে এসেই সুতির রাস্তা দুটিতে প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সীমান্ত উন্নয়ন তহবিল থেকে।” আলফাজুদ্দিনের কথায়, “পরদিনই উমরাপুরে যেতেই অন্য অভিজ্ঞতা। এখানেও প্রণববাবু আছেন। তবে তাঁর বেজায় ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা বলছেন উনি পারতেন গ্রামের রাস্তাটা ঠিক করে দিতে, কিন্তু করেন নি। সেই ক্ষোভ মেটাতে কম কালঘাম ছোটেনি আমাদের। এখনও যে ক্ষোভ মেটেনি তা বলা যায় না।” সাগরদিঘির ব্লক কংগ্রেস সভাপতি অলোক চট্টোপাধ্যায় বলছেন “প্রণববাবুর জায়গায় এ বার জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে দাড়াচ্ছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রণববাবুর ছেলে বলে। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় সুবিধা। মানুষ বুঝছেন প্রণববাবুর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে তাঁকে দরকার। অনেকেই প্রণববাবুর কাছাকাছি থাকার অতীত স্মৃতি স্মরণ করছেন। পথসভায়, জনসভায় সর্বত্রই প্রণববাবু আছেন। তিনি যে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন জঙ্গিপুরের গ্রামগঞ্জের মানুষ যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না।” |
একসময় প্রণববাবু যার বাড়িতে থেকে নির্বাচন যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেই মুক্তিপ্রসাদ ধর এখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু প্রণবদার ছায়ায় আচ্ছন্ন মুক্তিও নেমে পড়েছেন প্রণব পুত্রের হয়ে প্রচারে। তাঁর কথায়, “প্রণববাবু ৮ বছর সাংসদ ছিলেন। এমন কোনও এলাকা নেই যেখানে তিনি যাননি। বিরোধী নেতাদেরও তিনি মুখ দেখে চিনতেন। অনেকেই তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। বাবার এই ছত্রছায়াটাই পুত্র অভিজিৎবাবুর বাড়তি সুবিধা।” মুক্তিবাবু বলেন, ‘‘তা বলে কি ক্ষোভ নেই কোথাও? অনেকেই বলছেন দেশের অর্থমন্ত্রী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কী পারতেন না জঙ্গিপুরে একটা মহিলা কলেজ করে দিতে। পারতেন না শহরে একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নত মানের হাসপাতাল তৈরি করে দিতে। হয়তো পারতেন। ছেলে হিসেবে বাবার সেই সমস্ত কাজগুলিই করতে চান অভিজিৎবাবু। তৃনমূলে গিয়েও আমিও প্রণববাবুর টানে প্রচারে এসেছি।” রঘুনাথগঞ্জ ব্লক কংগ্রেস সভাপতি দিলীপ সিংহের মতে, “বড় মাপের মানুষ যিনি তাঁর ছায়া তো থাকবেই। তাই এই উপ নির্বাচনে বার বার উঠে আসছেন তিনি। একটা মহকুমা শহরে ২০টা ব্যাঙ্ক। আয়কর ভবন। এসব দেখে মানুষ প্রণববাবুকে তো মনে করবেই। অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় তাঁর ছেলে বলে প্রণববাবুর নামটা আরও বেশি করে সামনে আসছে। কিন্তু মুখে উচ্চারিত হলেও কংগ্রেসের প্রচারে কোথাও প্রণববাবুর নাম লেখা হয় নি। পোস্টার বা দেওয়াল লিখনে তাঁর নাম বা ছবি ব্যবহার করা হয় নি। অভিজিৎবাবুকে সকলেই তাঁর বাবার সঙ্গে তুলনা করে ফেলছেন। কিন্তু প্রণববাবু প্রণববাবুই। তাঁর সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। এমনকী ছেলেরও না।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য রাষ্ট্রপতিকে টেনে কোনও কথা বলা ঠিক হবে না-এ কথা মুখে বলেও পরক্ষণেই বলেন, ‘‘ সাংসদ হিসেবে প্রণববাবু পুরোপুরি ব্যর্থ। এত বড় ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে ৮ বছরে তিনি কী করেছেন এ প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ। তিনি যা পারেননি, ছেলে এসে তা করে দেবে মানুষ এ কথা বিশ্বাস করছেন না। কারণ অভিজিৎবাবু প্রণববাবুর নামে ভোট চাইছেন। জঙ্গিপুরে প্রণববাবুকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তিনি শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু নির্বাচনে প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর ছায়া পড়ছে।”
সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য জ্যোতিরুপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অভিজিৎবাবু সব জায়গায় নিজেকে প্রণবপুত্র বলে পরিচয় দিচ্ছেন। বাবার ভালো কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। তাহলে প্রণববাবুর ব্যর্থতার দায়ও তাঁকে নিতে হবে। জঙ্গিপুরে কংগ্রেস ও সিপিএমের রাজনৈতিক লড়াইয়ে আগাপাশতলা জুড়েই ব্যক্তি প্রণববাবুর ছায়াকে কেউ অস্বীকার করতে পারছেন না।”
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য জঙ্গিপুরে প্রচারে গিয়ে প্রণববাবুর কথা তুলে বলেন, “তৃণমূল আমাদের সমর্থন করায় জয়ের ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।” তিনি আরও বলেন, “অতীতেও দেখা গিয়েছিল প্রণববাবুকে বেকায়দায় ফেলার জন্য অতীতে বামেরা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। এবারও তারা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেস বিরোধী আন্দোলন করছে।”
খোদ অভিজিৎবাবুও স্বীকার করেন জঙ্গিপুর জুড়ে ছায়ার মতো প্রণববাবুর উপস্থিতির কথা। প্রতিটি জনসভায় তিনি বাবার কাজের প্রশংসা করছেন। তিনি বলেন, “বাবার আদর্শ অনুসরণ করেই রাজনীতি করতে চাই। জঙ্গিপুরে বাবার সেই সাফল্যকে সামনে রেখেই প্রচার করছি।” |