মোবাইলটা আমার চাই
কিছু একটা ঘষটানির শব্দ। পরে হঠাৎই সৃজার মনে হল শব্দটা ড্রয়ার টেনে ধরার। তখনই ঘুমের দফারফা। রাত দেড়টা-দুটো হবে হয়তো। সাবধানী হয়ে সৃজা পাশ ফেরে। ভয়ও হয়।
পড়ার টেবিলে ড্রয়ারের দিকে টর্চের আলো তাক করে ফেলতেই শরীরের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠল। ড্রয়ারের মুখ পুরোপুরি আলগা। এমনটা আগে ঘটেনি কখনও। ব্যাপারটা মোটেই ভাল ঠেকল না। তা হলে কি ছিঁচকে চোর? তা-ই বা কী করে? দরজা তো ভেতর থেকেই ছিটকিনি আটকানো। সৃজার হাত-পা অবশ। মাথার মধ্যে যেন ঝিঁঝিঁ ডাকে।
দাঁত চেপে একটুখানি মশারি তুলতেই ঘটে গেল বিপত্তি। আচমকাই আতঙ্কের ঝটকা সারা শরীর জুড়ে। দড়াম করে লাফ দিয়ে আগন্তুক হাজির। সে নিজেই আলোর সুইচ অন করে দেয়। এ বার সৃজার সামনে একটা জ্বলজ্যান্ত আস্ত লোক। চেহারাটা একটু বিটকেল গোছের। হাড় জিরজিরে, সামনের দাঁত দুটো বেশ উঁচু। কান দুটো যেন কুলোর খুদে সংস্করণ। লোকটার চোখেমুখে কাকুতি-মিনতি। মানে দাঁড়ায়, পারলে এই অধমকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সৃজা এমনিতেই নরম। লোকটার আবভাবে ও আরও নরম হয়ে পড়ে। ভয়ডরও হঠাৎ গায়েব।
সৃজা গলা ভারী করে শুধায় কে তুমি? মতলবটা কী তোমার? আমার ঘরে চুরি করার মতো কিছুই থাকে না। তা ছাড়া তুমি ঘরের মধ্যে ঢুকলেই বা কী করে?
লোকটা একটু ধাতস্থ হয়। আজ্ঞে, আমি নরহরি। চোর নই ভূত। না, না, আমি ভয় দেখাতে আসিনি।
দরজা বন্ধ। মোটা গ্রিলে মোড়া জানলা। মানুষ নয়, কেবল ভূতই পারে এই ঘরে কায়দা করে ঢুকতে। সামনে সাক্ষাৎ ভূত। অথচ সৃজা ভয়মুক্ত। বলিহারি সাহস বটে। নিজেই নিজের খানিকটা প্রশংসা করে ফেলে। বাহবা দেয়।
—এখানে আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটা জানতে পারি?
নরহরি মাথা চুলকোয়। বলে, বিলক্ষণ। আমার একটাই আর্জি, মোবাইলটা আমার চাই।
সৃজা দু’চোখ কপালে তোলে। মোবাইল! এঃ, এ যেন মামাবাড়ির আবদার! তা এখানে কেন? মোবাইলের দোকানে গেলেই তো হয়!
—অতশত বুঝি না। মোবাইল কী করে আদায় করতে হয় জানা আছে। তবে আমি আর পাঁচটা ভূতের মতো নই। ধুপধাপ লাফ মেরে মানুষের পো’র ঘাড়ে গেঁথে গিয়ে পা দোলানো আমার পোষায় না। ভালয় ভালয় বলছি মোবাইলটা দাও।
সৃজা গালে হাত দিয়ে একটু ভেবে নেয়। ঠিক আছে। আগে তোমার নামধাম জেনে নেওয়া দরকার।
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
—আজ্ঞে, আমি নরহরি। মানে, নর অর্থাৎ মানুষের মধ্যেই হরির বাস। সব মানুষের মধ্যেই ভগবান বিরাজমান।
—তুমি তো আর মানুষ নও। একটা আস্ত ভূত।
নরহরি ঝামড়ে ওঠে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে পা নাচায়। কথার রেশ টেনে ধরে নরহরি। আমার আগের সত্তাকে তো আর হেলাফেলা করতে পারি না! আসলে অ্যাদ্দিন মানুষ ছিলাম। আগের নামই চলছে চলুক, এই আর কী! ভূতেরা মানুষের পো’র মুখে হরি বা রাম নাম শুনলে ভাগাড়ের দিকে দৌড়ে পালায়। কিন্তু আমি তো আর সেই আমি নই! আমি স্বয়ং নরহরি। হরি সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। আমায় ভাগাবেটা কে, শুনি! ঘাড়ে একটারও মাথা থাকবে না। ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ বলে একটা কথা আছে, আমার সেই জাত।
সৃজা ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। ঠিকই তো। ও একটুও মন্দ বলেনি। নরহরি ফের বলে অবশ্য একটা ডাকনামও আছে আমার। ন্যাটকা। টাটকা প্রপার নাউন। কেউ কেউ আবার ন্যাটকা শব্দটাকে ঘটা করে অ্যাডজেকটিভ বানিয়ে আমায় ডাকে ন্যাটকাসেয়ানা। তুমি আমাকে ন্যাটকাদা বলে ডাকতে পারো। তা ছাড়া নামে কী-ই বা এসে যায়। একটা কিছু ডাকলেই হল। এই যেমন, তোমারও ডাকনাম হল গিয়ে আতা।
নরহরি সত্যিই সেয়ানা। কথায় মারিতং জগৎ। তবে সৃজা এ বার নিজেই একটু লজ্জা পায়। ব্যাটাচ্ছেলে ওর এই অবলুপ্তপ্রায় ‘আতা’ নামটা জানল কী করে? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সৃজা চেয়ে থাকে।
—আমাকে সব রকম খবরাখবর রাখতে হয় বুঝলে তো! আসলে সংকর ধাতুর আদলে গড়া তোমার ওই ডাকনাম। বাপের নাম আকাশ। আকাশের ‘আ’। আর মায়ের নাম তানিয়া। তানিয়ার ‘তা’। হয়ে গেল আতা। নামকরণটা তোমার পিসোর। পিসোর এলেম আছে বটে!
নরহরি একশো ভাগ ঠিক। তবে প্রসঙ্গটা চেপে যাওয়াই এখন আসল বুদ্ধিমানের কাজ। এই পিসেমশাই পরে সৃজার ছোট বোনের নাম রাখতে চেয়েছিল ন্যাতা। আতার বোন ন্যাতা। ভাগ্যিস, সে অঘটন ঘটেনি। এ বার সৃজা প্রসঙ্গ পালটায়। তোমার থাকা হয় কোথায়?
অ্যাদ্দিন শিয়ালদার কারশেডে আখড়া গেড়েছিলাম। আর ক’দ্দিন আশ্রয় জুটবে জানি না। সব জায়গায় পলিটিক্স। পাশের শ্মশানটা ভূতেদের বস্তি এলাকা। ওখানে থাকে হ্যাড়ান্যাড়ার দল। আমি বারাকপুর লোকালে কাটা পড়ে সটান কারশেডে চলে যাই। তখন মস্ত খাতির। আমার গলায় মস্ত মালা চড়িয়ে বরণ করা হল। রোজ বিকেলে কচিকাঁচারা গা-হাত-পা টিপে দেয়। প্রায় রাতেই মেহফিল বসে ওখানে। নাচগানের আসর। মিস রুকসানা আমার পাশের গলিতেই থাকে।
—সেটা আবার কে?
—ওই একটা নাক থ্যাবড়া ভূতনি। ক্যাটক্যাট করে কথা বলে ঠিকই, তবে গানের গলাটা অসাধারণ। গান শুনেই আমি ওর দিবানা হয়ে যাই। সামনের মাসেই ওর সঙ্গে আমার বিয়ে। ঘেয়ো কুকুরের কামড়ে মরেছিল বলে রুকসানার স্বভাবই হচ্ছে একে ওকে কামড়ে দেওয়া। মতের মিল না হলে ও আমাকেও কামড়ে দেয়। ভেবো না, বিয়ের পর তোমার বউদিমণিকে নিয়ে এক দিন আসব’খন।
সৃজা হি হি করে হাসে। দারুণ বলে বটে নরহরি। তা তোমার আগমনের প্রকৃত হেতু জানলে কৃতার্থ হই।
কথার খেই পায় নরহরি, মোবাইলটা আমার চাই।
ধ্যাৎতেরিকা। আবার সেই ঘ্যানরঘ্যানর। সৃজা এ বার ঝাঁঝিয়ে বলে কীসের মোবাইল, কার মোবাইল? অদ্ভুত বায়না তো তোমার?
—আমার মোবাইল এই ঘরের মধ্যেই আছে। মোবাইলের গন্ধ পেয়েই আমি এখানে এসেছি।
সৃজা হাঁ। মোবাইলের গন্ধও আছে তা হলে। ওর হাঁ মুখ বন্ধ করতে নরহরি বলে কানে মোবাইলটা ঠেকিয়ে গান শুনতে শুনতেই আমি রেললাইন পার হচ্ছিলাম। কী যেন গানটা, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। হোয়াই দিস কোলাভেরি কোলাভেরি ডি...। তেড়েফুঁড়ে আসা ডাউন রানাঘাট লোকাল সামলে লাইনটা ঝড়ের বেগে ক্রশ করলাম। পিছন থেকে হঠাৎ ডাউন বারাকপুর এসে আমায় ফাল্লাফাল্লা করে বেরিয়ে গেল। কাটা পড়েই জ্যান্ত কাটা শোলমাছের মতো ছটফট করি। ডান হাতটা ছিটকে কোথায় গেল খোঁজার চেষ্টা করি। হাতটা খুঁজে পেলেও লাভ ছিল না। কপালে মরণ ছিলই। মরে বাঁচলাম। মোবাইলটা রাস্তার ধারে কাঁটাঝোপের আড়ালে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতি পথে তুমিই ওই মোবাইল কুড়িয়ে এই ঘরে এনে রেখেছিলে। কী, মনে করে দেখো তো!
এ বার সব মনে পড়ে সৃজার। নরহরি একটুও বানিয়ে বলেনি। দু’মাস আগেই ও একটা মোবাইল লাইন ধারে কুড়িয়ে পায়।
—একদম ঠিক বলেছ। কিন্তু এখন ওটা তো একটা অকেজো মোবাইল। দুমড়ানো মুচড়ানো একটা ভাঙা খেলনার মতো। আমি এমনিই ওটা আমার পুরনো বইয়ের বাক্সে ফেলে রাখি।
—মোবাইলটা আমার চাই। ওটাই আমার মৃত্যুর কারণ। আমি স্মৃতি করে রাখব। আর অন্যরা সবাই জানবে কানে মোবাইল গুঁজে রাস্তা পেরোলে কী দশা হয়।
সৃজা চোখ দিয়ে মোবাইলের অবস্থান বুঝিয়ে দেয়। একটুও সময় লাগল না। লাফ দিয়ে বাক্স পেড়ে নরহরি ওর খোয়ানো মোবাইল উদ্ধার করে। সৃজার ওপর ও বেজায় খুশি। নরহরির আনন্দও রেকর্ড করে রাখার মতো।
সৃজাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে এ বার নরহরি নিজের আনন্দ-উত্তেজনা প্রশমিত করে। বলে কলেজে ভর্তির সময় আসুক। কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি একটা খুব সুন্দর দামি নতুন মোবাইল গিফ্ট করব। মা কালীর দিব্যি। এখন আসি তা হলে!
আর দাঁড়ায়নি নরহরি। নিমেষে উধাও।
অনেক দিন কাটল। নরহরির পাত্তা নেই এখনও। তবে ও আসবেই। কলেজে ভর্তির আর মাত্র দেড়টা বছর। তখন ও আসবেই। সুগায়িকা রুকসানা বউদিমণিকে নিয়েই আসবে। আর কলেজ ভর্তির আগে নরহরির সঙ্গে দেখা হলেই বলবে এ বার আমার মোবাইলটা চাই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.