রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
অডি পর্ব
সলে চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হয়ে যাওয়াটাই সমস্যার। টেলিভিশনে অডিশন দিয়ে সুযোগ পেয়ে প্রথম থেকেই দারুণ অভিনয় করছে এমন উদাহরণ আছে, বেশ কিছু ছেলেমেয়ে সত্যিই প্রতিভাবান। আর এদের সাফল্যটাই বাকিদের গোড়ায় জল ঢেলেছে। পাল পাল ছেলেমেয়ে ভাবছে, এ আর এমন কী? ‘তুমি কী হতে চাও?’-এর উত্তর হল, ‘ইউ নো, জাস্ট লাইক, কোয়েল, শ্রাবন্তী, শুভশ্রী।’ বোঝাই, ওঁরা তো সিনেমা করেন। তাতে সে বলে, ‘দেন আমি টেলিভিশন থেকে সুইচ ওভার করব।’ মাস দেড়েক আগে, টানা অডিশন নিয়েছি। ‘কী শিখেছ?’ প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি, ‘সুইমিং জানি, সালসা ডান্স শিখছি লাস্ট থ্রি মান্থস, আর রিসেন্টলি ড্রাইভিংটা শিখছি, মোটামুটি পারি, ব্যাক করতে একটু জাস্ট চাপ হয়।’ এর পর চারটে লাইন দেওয়া হল মুখস্থ করে বলার জন্য, চল্লিশ মিনিট পর বলতে ঢুকে পাঁচ বার হোঁচট খেল। অ্যাক্টিং করতে এসে অন্য সব শিখেছে, অভিনয়টা শেখার দরকার পড়েনি। আমাদের চিত্রনাট্যকার নাট্যপ্রেমী, সে সবাইকে প্রশ্ন করে ‘নাটক করেছ?’ একটা মেয়ে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলায় খুশি হয়ে সে পরের প্রশ্ন করে অতি উৎসাহে, ‘কোন দল?’ মেয়েটা বলে ‘ওই বিপ্লবী সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন আছে না, ওখানে নেমে দু-মিনিট হেঁটে যেতে হয়।’ দলের নামটাও জানে না, এমন নাট্যকর্মী সে।
নাটকের অভিনয়-স্কুলে রোজ অনেকে হানা দেয়, একটু টিভি-তে ‘চলেব্ল’ অ্যাক্টিংটা শিখিয়ে দেবেন? টিভি-তে এখন নাকি আগে ‘লুক’ দেখা হয়, সেটাই আসল, অভিনয়টা নাকি কয়েক দিনের ওয়ার্কশপ করলেই হয়ে যায়। এটা কে কার মুখ থেকে শুনেছে কে জানে, কিন্তু এটাকেই বেদ-বাইবেল ধরে পিলপিল করে লোক আসে। করবে মেগা, যেখানে রোজ ঘড়ি ধরে ২৩ মিনিট ফুটেজ তুলতে হয়, অডিশনে এসে প্রথমেই কয়েক জন বলে রোমান হরফে লিখে দিতে, আসলে ওদের ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল ইংরেজি আর সেকেন্ডটা হিন্দি। পড়তে না পারি, অভিনয় না করার কী আছে? ওই চার লাইন হাতে নিয়ে একটি মেয়ের মাথা ঘুরতে লাগল। সে নাকি সোজা জিম থেকে চলে এসেছে। দয়া জেগে উঠল। কিছু খাবে? আনাব? মেয়েটা এই কুপ্রস্তাবে আঁতকে উঠল, ব্যাগ থেকে ফ্রুট জুস বের করে খেতে থাকল, ওরে খালি পেটে আরও গা গুলোবে, কে কার কথা শোনে, এটা নাকি ইনসট্রাকটরের হুকুম। তার আধ ঘণ্টা পর আবার বলতে এসে দু-লাইন পর হোঁচট এবং গজে আগমনের পর দোলায় গমন। রাতে অনলাইন পেয়ে ফেসবুকে অনুরোধ, ওই চারটে লাইন একটু এখানে লিখে দেবেন? তা হলে কাল এক বার যেতাম...। ছেলেরাও কম নয়, বেশ কয়েক জন আসে ছোট গেঞ্জির হাতা গুটিয়ে, ওর হয়ে সব উত্তর ওর বাইসেপ দেবে। তার পর তাকে ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি’ বলতে বলো কিংবা ‘ও আমার দেশের মাটি’ সব কথাই ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’-র কপি অ্যান্ড পেস্ট। স্তানিস্লাভস্কি এদের স্বপ্নে এসে বলে গিয়েছেন, অ্যাংরি ইমেজটাই হল ওঠার সিঁড়ি। খবরের কাগজ পড়ো নিয়মিত? দশ জনের সাত জন বলেছে ‘না’। এদিকে হাতে ট্যাটু আছে, রোজ তিনটে ডিমের সাদাটা খেতে হয় সেটা জেনে গিয়েছে। একটা আউটডোরের আড্ডায় হঠাৎ উঠে আসে জীবনানন্দের নাম, সেই সিরিয়ালের নায়িকা কাজলকালো চোখ বড় বড় করে বলেন, ‘ইনি কে?’ কেউ এক জন বলে, তুই একে চিনবি না, ফেসবুক, ট্যুইটার, জি-টকে নেই তো। এমন অনেকের ফ্যান ক্লাব আছে, যারা অ্যাক্টিং করা মানেই বোঝে চোখে চশমা, হাতে মোবাইল। এতে হাত আর চোখদু’টোর ব্যবহার নিয়েই বিপাকে পড়তে হয় না। তাই অডিশনে ভিড় হবেই। আবার কয়েক জন অডিশনে ঢোকেই সকলকে তাচ্ছিল্য করবে বলে। এরা কোনও বড় দলে অভিনয় করে, আর তাই ভাবে, অভিনয়টা শুধু তারাই জানে। তা ছাড়া তাদের কাছে ইনফর্মেশন আছে, এই অডিশন-ফডিশন সব সাজানো, তলে তলে সব ফিট করা আছে। ওরে, এ কি করপোরেশনের বাতি যে লোক দেখিয়ে টেন্ডার ডাকতে হবে? কে কাকে বোঝায়? যে প্রশ্নই করো, ট্যারা উত্তর দেবে, যেন সে আসতে চায়নি, গণ-দাবিকে সম্মান দিতেই এসেছে। তার পর ক্যামেরা রোল হলেই হুঙ্কার ছুড়বে, অবাক হওয়া মানেই রসগোল্লার মতো চোখ করবে, আসলে স্টেজ আর ক্যামেরার ফারাক না বুঝবে, না শুনতে চাইবে। একশোর মধ্যে দশ জন অভিনয় জানে, তবু নব্বই জন ফোটোশপে তরিয়ে দেওয়া ছবি নিয়েই ঘুরবে এখান সেখান, শুধু শিখতে এদের আপত্তি। স্কুলে তো অ্যাক্টিং করেছি, নাচটাও জানি, ফিগারটাও ভাল, ব্যস, আর আমাকে পায় কে? কয়েক জনের ছবির পিছনে লম্বা লিস্ট। তাতে দারুণ কিছু সিনেমার নামও আছে, তবে সে ছবিতে তাকে খোঁজার চেয়ে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজা অনেক সহজ। নায়িকা যে কলেজে পড়ত সেটার ক্যান্টিনে অনেকের সঙ্গে চা হাতে ব্যাক টু ক্যামেরা বসে ছিল। সে-ও আসে। প্রোডাকশন হাউস থেকে যে বেচারা ফোন করে সকলকে অডিশনের খবর দেয় তাকেই বলে, তুমি কফি খাও?
এক বার একটা অডিশনে বসে আছি, দশ জন আসবে। প্রথমেই ঠিক করলাম আজ আর সিরিয়ালের সংলাপ দেব না, আমরা বড্ড রিজিড হয়ে যাচ্ছি, সবার মধ্যে ক্যারেকটার খুঁজছি, আগে দেখি সে অভিনয় পারে কি না, ভাবতে পারে কি না, তার পর না হয় আমাদের সংলাপের পাতা ধরাব। দশ জনকেই একসঙ্গে ডাকলাম। বললাম, ভাই, কোনও স্ক্রিপ্ট নেই, তোমরা নিজেরা ভাবো, তোমার জীবনের কোনও একটা ঘটনা তুমি এসে বলো, ক্যামেরাটাকেই তোমার সঙ্গে কথা বলার লোক ভাবতে পারো, যদি চাও। আমরা চাই তোমরা নিজেরা কিছু ক্রিয়েট করো। মুহূর্তে দশ জন দশ দিকে ছিটকে গেল। দূর থেকে দেখছি, সবাই ভাবছে, কেউ হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছে, কেউ বসে বসে হাত-পা ছুড়ছে। মিনিট তিরিশ পর দু-এক জন উঁকি দিল, একে একে ডাকা শুরু। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, দশ জনের আট জন আলাদা আলাদা ভাবে বিষয় ভেবেছে ‘বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ’! কেউ বলছে, বাবা তোমার জন্য আমার সানিকে বিয়ে করা হল না, কেউ বলছে আমি অভিনয় করবই বাবা, তুমি যতই বাধা দাও শুনব না, এক জন চিৎকার করে উঠল, ‘আমি ডাক্তার হতে চাই না বাবা, কেন তুমি জোর করছ?’
অডিশন কারা দেয়? অডিশন কেন হয়? এ দু’টো কেজি ক্লাসের প্রশ্ন। এখন সময় নতুন মুখের। অধিকাংশ ধারাবাহিকের নিয়ম, বাবা-মা-বৌদি হবেন চেনাজানা, নায়ক-নায়িকা চাই নতুন, সরি, বলা হয় ‘ফ্রেশ লুক’। আর নাচা-গানার রিয়েলিটি শো তো আছেই। তাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে। ফেসবুক কিংবা টিভি-স্ক্রিনের নীচে ঝড়ের গতিতে লেখা ছুটে যাক, অডিশন আর একটা যোগাযোগের নম্বর দিয়ে, তার পরেই শুরু সুনামি। নাচের রিয়েলিটি শো-র অডিশনে প্রতি বার পুলিশ থিকথিক করে। একটা কুইজের অনুষ্ঠানে, কেন সবার অডিশন হবে নাএই অভিযোগে এমন হট্টগোল, শেষে কর্তাদের থানা ভ্রমণও করে আসতে হয়। হুল্লোড় বাড়ে, যদি চ্যানেল হয় নামী, আর অ্যাংকর হন সুপারস্টার। আবার, সব দোষই কি ওই টিভি-তে মুখ দেখাতে চাওয়া মানুষগুলোর? না। সরষের মধ্যে বারো ভূত লাফালাফি করছে। এই গনগনে রোদের তলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেওয়া মানুষগুলো আসলে জানেন না, বড় চ্যানেলের কুইজ-এ (বা অন্য কিচ্ছুতে) সুযোগ পেতে হলে, উত্তর (বা নাচ-গান) না জানলেও হবে, কিন্তু প্রেজেন্টেব্ল হতে হবে, বাচাল নয় তবে চটপটে হতে হবে, আর আপনার জীবনে বেশ কয়েকটা ইন্টারেস্টিং স্টোরি থাকতে হবে। এক বার একটা গানের রিয়ালিটি শো-র এক জন প্রতিযোগী ছোটবেলায় সবজি বিক্রি করেছিল। এখন তার গাড়ি-বাড়ি সব আছে, তবু সে প্রতি বার গাইতে ওঠার আগে আমায় অবধারিত ভাবে কেউ-না কেউ এসে মনে করিয়ে যেত, ‘ওই ভেজিটেব্ল-এর স্টোরিটাকে আর একটু ইমোশন দিলে ভাল হয়’!
ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.