সুমন: অনেক দিন দেখা হয়নি, পত্রিকার সুবাদে সেটা হয়ে গেল। প্রথমে তোমায় জিজ্ঞাসা করছি কেমন আছ? পেশাগত আর ব্যক্তিগত ভাবে—কেমন আছ?
রূপা: এটা কি ইন্টারভিউ করার জন্য সুমনবাবু প্রশ্ন করছেন নাকি?
সুমন: না না না, বাড়িতে যেমন আড্ডা মারি সেরকম আড্ডা হচ্ছে, আমি অনেক দিন পর আমেরিকা থেকে তোমার কাছে এসেছি। জানতে চাইছি তুমি কেমন আছ।
রূপা: এসেছ নয়। স্কাইপে (হাসি)
সুমন: আচ্ছা ঠিক আছে। স্কাইপেই।
রূপা: আমি ভীষণ ভাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমত সামনে আমার বেশ কয়েকটা ছবির রিলিজ আছে। পর পর বেশ কয়েক দিন ধরে আমি কলকাতায় বেশ কতকগুলো ছবি করলাম। তার জন্য ভাল আছি। নিজের শর্তে এত বছর কাজ করে চলেছি, তাও যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে প্রচুর মানুষের ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিয়ে। ঠিক যে ভাবে বাঁচতে চাই এই মুহূর্তে সেই ভাবেই বেঁচে আছি।
সুমন: আর ব্যক্তিগত ভাবে?
রূপা: ব্যক্তিগত ভাবে ভাল আছি বলেই আমি মানুষটা ভাল আছি। আমি তো ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নই। আমার ভাল থাকার মধ্যে বাগানের ফুলগুলো ঠিক আছে কি না সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমার ঘরদোর পরিষ্কার আছে কি না সেটাও একটা ব্যাপার।...আমি এখন বেশি পার্টিও করছি না, বেশি ড্রিঙ্ক করছি না, বেশি খাটনিও হচ্ছে না। একটা মডারেট, সাধারণ সুন্দর জীবন। ভোরবেলা রোজ ঘুম থেকে উঠি। ওঠার পর একবারও মনে হয় না আরও একটু ঘুমোই। আর তা ছাড়া কলকাতায় এখন ক’দিন ধরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। তাই আমি খুব খুশি। |
সুমন: এ বারে একটু পিছনে চলে যাই। কারণ এখনকার নায়িকাদের মধ্যে তুমি সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম যাঁরা ধরো শেষ কুড়ি বছর....তোমার কত দিন হল ইন্ডাস্ট্রিতে।
রূপা: পঁচিশ বছর।
সুমন: পঁচিশ বছর ধরে তুমি আছ। তার মানে সেই আশির দশক থেকে এখনও পর্যন্ত...তোমার কেরিয়ার নিয়ে যদি প্রশ্ন করি, একটা জিনিস মেজর অ্যাচিভমেন্ট, যার জন্য বাকিরা তোমায় এখনও ভুলতে পারে না। যার জন্য আজ গবেষণার বিষয় রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। যেমন ধরো ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘যুগান্ত’, ‘অন্তরমহল’সবগুলোই ইন্টেলেকচুয়াল ছবির পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু সো-কলড, কমার্শিয়াল ছবি থেকে তুমি সচেতন ভাবে একটু দূরে ছিলে। নাকি এটা হয়ে গিয়েছিল?
রূপা: ইউ আর ট্রাইং টু পুট ইট ইন এ মডেস্ট ওয়ে (হাসি)। কমার্শিয়াল ছবিতে আমাকে মানাত না।
সুমন: তোমার ইচ্ছে ছিল?
রূপা: আমার ইচ্ছে ছিল না। আমি স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম না বলেই আমায় মানাত না। গাছের ডাল ধরে নাচ গান আমি করতে পারতাম না। আমি দেখলাম এ সবে আমি একেবারে মিস ফিট। এ সব পারছিও না। স্বচ্ছন্দও নই... আর পরিচালকেরাও বুঝে গেলেন এ মেয়ের যা রাগী রাগী কাঠ কাঠ মুখ চোখ তাতে একে দিয়ে ওই সমস্ত ন্যাকা ন্যাকা চরিত্র হবে না। তাই আমি ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তার জন্য আফশোস করি না আমি। আর ঠিক তখনই টিভিতে একগুচ্ছ ভাল ভাল টেলিফিল্মের কাজ শুরু হয়। যেটা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে।
সুমন: তোমাদের মতন এই রকম অভিনেত্রীরা যাঁদেরকে সাধারণত বলা হয়, “থিংকিং ম্যানস উইমেন” তারা তো আসলে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যান। সেটা নিয়ে কোনও আফশোস নেই তোমার?
রূপা: নাহ্। কারণ সেটার জন্য আমি কোনও দিন চেষ্টাই করিনি। আমি যেটা করতে স্বচ্ছন্দ নই সেটা করার চেষ্টাই বা করব কেন? আমি নিশ্চিত যদি আমি চেষ্টা করতাম তা হলে দুশো শতাংশ সফল হতাম। কিন্তু আমি কোনও দিন সেটা চেষ্টাই করিনি।
সুমন: ধরো ঋতুপর্ণা। ও কিন্তু সমান তালে দু’ধরনের ছবিতেই কাজ করেছে। ওর যা গ্রহণযোগ্যতা সেটা তো তোমার নেই।
রূপা: নিঃসন্দেহে নেই। সেটা এক বাক্যে স্বীকার করি। তবে ও কিন্তু আমার থেকে অনেক পরে, প্রায় ছ’ সাত বছর পরে ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছে। সে সময় আমি অলরেডি কমার্শিয়াল হিরোইন হওয়ার সময়টা পেরিয়ে এসেছি। আসলে আমি আবার বলছি ওই ধরনের কাজ করার চেষ্টাটাই আমি করিনি। ধরো ‘যুগান্ত’তে কাজ করার জন্য আমি এক বছর ওড়িশি শিখেছি। সেই চেষ্টাটা তো আমি ওই রকম ছবিতে কাজ করার সময় করিনি। কারণ ‘যুগান্ত’ করতে আমি যতটা উৎসাহী ছিলাম এই ধরনের ছবিতে কাজ করার জন্য কখনই ছিলাম না।
সুমন: তোমার চেহারা আর ভাবমূর্তির মধ্যে এমন একটা দারুণ সফিসটিকেশন কাজ করে, শাড়ি পরা, সাজগোজ সব মিলিয়েআমরা এই জেনারেশনের পরিচালকেরা তোমাকে ওই ধরনের চরিত্রে কাস্ট করতে চাই। মনে আছে তুমি একবার ঘরোয়া আড্ডায় আমাকে বলেও ছিলে ‘শুকনো লঙ্কা’য় মিঠুনের বউয়ের চরিত্রটা তুমি করতে চেয়েছিলে। সেখানে সব্যসাচীর বউয়ের রোলটা তোমাকে অফার করা হয় বলে তুমি রাজি হওনি। তুমি কাজের লোক বা গ্রামের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চাইলেও পরিচালকেরা তোমায় ভাবছেন না। সে ক্ষেত্রে তোমার এই লুকটা ‘বার্ডেন’ বলে মনে হয় না?
রূপা: হা হা হা। (জোরে হাসি, তার পর সোজা হয়ে বসে)। দ্যাখো যদি কোনও পরিচালক নতুন কিছু ট্রাই না করেন সেটা তাঁর ‘লস’। আমি ওই রকম চরিত্রে অভিনয় করার জন্য অনায়াসে প্রযোজকদের রাজি করাতে পারি ছবি করার
জন্য। কিন্তু আমি অভিনয় ছাড়া মিডিয়েটারের কাজ করি না। তাই যত দিন না কোনও পরিচালক আমায় নিয়ে নতুন কিছু ভাবছেন তত দিন ওই রকম চরিত্রে আমার কাজ করা হবে না।
সুমন: তুমি মানুষ হিসেবে খুব ইমোশনাল। সেটা সবাই বলে এবং আমিও কিছুটা জানি। কিছু হলেই তুমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দাও।
রূপা: একটা মারব (হাসি)।
সুমন: হা হা.....
রূপা: ইমোশনাল মানুষ হলে যেটা হয়, সুবিধেও আছে। আবার অসুবিধেও আছে। ধর আজকে আমি ইমোশনাল মানুষ। কখনও শুনলাম তোমার কোনও বিপদ হল। আমি তোমার কাছে দৌড়ে গেলাম। ফোন করলাম। তুমি বললে, “দ্যাখো মানুষটা কত ইমোশনাল, কত যত্নশীল, নিজের কোনও স্বার্থ ছাড়াই কেমন দৌড়ে এল। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।” পাশে একটা লোক কিন্তু আমাকে বোকাই বলবে। সুতরাং
এটা পুরোটাই দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার।
কে কী ভাবে দেখছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বার ঠকা কাকে বলবে তুমি? প্রত্যেকটা ঠকাই কিন্তু জীবনে বড় অভিজ্ঞতা।
সুমন: কিন্তু একটা সময় তোমার খুবই কষ্ট গিয়েছে জীবনে।
রূপা: (থামিয়ে দিয়ে) নিশ্চয়ই। হওয়ারই কথা। সব কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতেই হবে। এটা জীবনেরই অঙ্গ।
সুমন: না, তোমায় ব্যক্তিগত চাপের কথা বলছি। তোমার শেষ ইন্টারভিউতেও তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে লোকে জানতে পেরেছে। আমি গভীর ভাবে কিছু জানতে চাইছি না। আমি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছি। মানে ওই ঘটনার পর তুমি কতটা বদলেছ?
রূপা: না। আমার মনে হয় না মানুষ হিসবে আমি বদলেছি।
সুমন: ও কে। পরের সপ্তাহে তো তোমার ‘অবশেষে’ রিলিজ করছে। খুব ভেতর থেকে বলো তো, টেনশন হচ্ছে?
রূপা: মুচকি হেসে (একটু)
সুমন: টেনশনটা কীসের? এটা মুখ্য চরিত্র হিসেবে কামব্যাক ছবি বলে? যদিও তোমার মুম্বই চলে যাওয়ার পর লোকে তোমায় ‘হেমলক’, ‘নোবেল চোর’ এ সব ছবিতে দেখেছে।
রূপা: আসলে এই ছবিটায় আমার ওপর অনেকটা দায়িত্ব আছে। গল্পটা আমাকে নিয়েই। আর অদিতি নতুন পরিচালক। ওর পেছনে বড় ইতিহাস কিছু নেই, যে লোকে ‘হেমলক’ বা ‘চিত্রাঙ্গদা’ দেখতে যাবে। সে রকম কিছু তো নেই। সেখানে অদিতি যেহেতু নতুন তাই আমার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। আমি খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। আমার কোনও কিছু চট করে ভাল লাগে না। সেখানে আমি বলব ‘অবশেষে’ আমার খুব ভাল লেগেছে।
সুমন: ‘অবশেষে’ সিনেমাটা যত কাছে আসছে তত কি মনে হচ্ছে যে জাতীয় পুরস্কারটা গানে না হয়ে অভিনয়ে হলে ভাল হত। আনন্দ হচ্ছে, না হতাশা?
রূপা: আমার যেটা মনে হয়েছে সিচুয়েশনটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। সিঙ্গার হিসেবে আমি পাইনি। এটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইমপ্যাক্ট। ‘দূরে কোথাও’ ছাড়া অন্য কোনও গানে অ্যাওয়ার্ডটা হত বলে মনে
হয় না।
আর হতাশা অ্যাট লিস্ট হচ্ছে না। প্রশ্নই নেই। আনন্দও নয়।
সুমন: জীবনের সেরা প্রেম কাকে?
রূপা: যাঃ বাবা, হঠাৎ কোথা থেকে চলে এল?
|
সুমন: বলোই না।
রূপা: রবীন্দ্রসঙ্গীত।
সুমন: ধ্যাৎ...
রূপা: এত বিরক্ত হওয়ার কী আছে! যা শুনতে চাইবে সব সময় আমাকে তাই বলতে হবে নাকি!
সুমন: এই পঁচিশ বছরে প্রেম পেশার কতটা ক্ষতি করল?
রূপা: কী ক্ষতি কী লাভ জানি না। তবে সংসারকে সারাজীবন প্রায়োরিটি দিয়ে গিয়েছি। তাতে যদি পেশার ক্ষতি হয়ে থাকে সে হিসেব আমি রাখি না।
সুমন: তোমাকে ইন্টারভিউয়ের শুরুতেই বললাম, তুমি ঋতুপর্ণা নও। কিন্তু তোমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে পুরুষদের দুর্নিবার আকর্ষণ আছে। যখনই কলকাতা যাই দেখি সবাই আলোচনা করে। এটা কেন?
রূপা: পুরুষরা কেন আমাকে আকর্ষণীয় মনে করে তার উত্তর ওরা দিতে পারবে। ওদের কাছে জানতে চাও।
সুমন: এটা বিশ্বাস করতে হবে তুমি জানো না?
রূপা: বলব না। স্কাইপেই মারব কিন্তু (হাসি)।
সুমন: তাও বলো না, তারা এস এম এসে তোমায় কী লেখে?
রূপা: লেখে, ‘আই লভ ইউ’। কেউ কেউ আবার ‘আই ফাইন্ড ইউ ভেরি সেক্সি’, ‘ভেরি অ্যাট্র্যাকটিভ’—এই সব পুরনো শব্দও লিখে ফেলে।
সুমন: এই যে পঁচিশটা বছর শেষ করলে দশের স্কেলে নিজেকে কত দেবে?
রূপা: আমি দুটো ক্যাটেগরি করতে চাই। অভিনয় ক্ষমতা আর স্বীকৃতি। প্রথম হেডটাতে আমি নিজেকে ৫ থেকে ৬ দেব। স্বীকৃতিতে দেব ৪। জাস্ট পাস মার্কস।
সুমন: আবার যদি নতুন করে শুরু করার সুযোগ থাকত, কী কী জিনিস পরের পঁচিশ বছরের জন্য বদলাতে?
রূপা: এটা তো তুমি ‘অবশেষে’র শুচিস্মিতার মতো বললে। শুচিস্মিতা মজা করে বলেছিল জীবনটা যদি আবার নতুন করে শুরু করা যেত। তিনটে বিভাগের কথা বলি। কী ভাবে নতুন করে শুরু করতাম।
প্রেম: করতেই থাকতাম। কিন্তু লুকিয়ে করতাম। সবাইকে জানাতাম না।
বিয়ে: কখনও করতাম না। বিয়ে না করে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতাম।
পেশা: চেষ্টা করতাম নিজেকে অভিনেতা হিসেবে গ্রুমিং করতে। অমিতাভ বচ্চনকে রাজি করাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম যদি উনি আমাকে অভিনয় শেখাতে রাজি হন।
সুমন: সত্যি বলছ এতগুলো বদলাতে?
রূপা: একদম সত্যি সুমন (হাসি)।
|