|
|
|
|
|
|
|
আপন মনের গরল মিশায়ে
খাদিম হুসেন রাজা রচনা করেছেন একাত্তরের ইতিহাস। যে ইতিহাস
ভুলে ভরা,
মনোবিকারে জারিত। দুর্ভাগ্য, অনেক ভারতীয়ই এই
বিকৃতিকে
পাকিস্তানের
মানুষের
সাধারণ বিশ্বাস বলে মনে করেন।
রাজা’র
বইটি পড়েছেন মণিশঙ্কর আইয়ার |
|
|
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি হিসাবে পাকিস্তানের সৃষ্টি ও বিবর্তনের অধ্যায়টা সমাপ্ত হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যখন গভর্নর নিয়াজি নতুন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ-এর জন্মের ঘোষণাসংবলিত আত্মসমর্পণ-চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই পাকিস্তানেই তাঁর ফৌজি জীবনের কয়েকটা বছর কাটিয়েছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা। ১৯৬৯ থেকে ’৭১ পর্যন্ত সেই স্বদেশে কাটানোর অভিজ্ঞতাই তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। কায়েদ-এ-আজমের সেই অবিভাজ্য কল্পরাষ্ট্রের শেষ কয়েকটা দিনের সাক্ষী তাঁকে থাকতে হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ডেপুটি মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং ঢাকায় মোতায়েন ডিভিশনের সেনাপতি হিসাবে। সেই সাক্ষ্যে ফুটে ওঠে, কী ভাবে ইসলামাবাদের নিজেরই আঘাত-করা ক্ষতস্থান পুঁজ-রক্তে পচে গিয়েছিল, যে জন্য অস্ত্রোপচার করে তা কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
১৯৬৯-এর শেষ দিকে খাদিম হুসেন রাজা যখন খুলনায় এসে পৌঁছন, তাঁর নিজেকে খুব বাঞ্ছিত, স্বাগত মনে হয়নি। বরং যেন কোনও শত্রুরাষ্ট্র থেকে এসেছেন, এমন একটা পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়। ‘নিজের দেশ’-এই এমন অবাঞ্ছিত হয়ে ওঠার রহস্যটা তিনি বুঝতে পারেন না, যেহেতু উপমহাদেশের মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র স্বদেশের ধারণাটির মধ্যে নিহিত মৌলিক ত্রুটিটা তিনি কখনওই ধরতে পারেননি। তার বদলে তিনি পাক ভূখণ্ডে তখনও রয়ে যাওয়া ২০ শতাংশ হিন্দু সংখ্যালঘুর উপর দোষ চাপিয়ে গেছেন। ওই হিন্দু সংখ্যালঘুদের অপপ্রচার, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতের জন্যই পূর্ব পাকিস্তানের পরিবেশ বিষিয়ে উঠেছে, এমনই ছিল তাঁর ধারণা। এই ধরনের অপপ্রচারই শেখ মুজিবের জনসভার বিপুল সমাবেশকে উদ্বেল করে তুলত। বস্তুত, জনসাধারণের বর্ধমান ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের বদলে ষড়যন্ত্র খোঁজার এমন আত্মতৃপ্ত মনোভাবই পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের বাংলাদেশের চোরাবালিতে নিমজ্জিত করে দেয়। তাঁরা বুঝতেও পারেন না স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়, ভাষা-পরিচয়, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-পরিচয় ভিত্তিক যে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে জায়মান, ‘উপমহাদেশে মুসলিম স্বদেশ’-এর সংকীর্ণ, একমুখী, ফালতু প্রকল্প দিয়ে তার মোকাবিলা করা যাবে না। যে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ মাতৃভাষা হিসাবে উর্দু ব্যবহার করত, সে দেশের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসাবে উর্দুকে ঘোষণা করে দেওয়ার মধ্যে কায়েদ-এ-আজমের যে মূঢ়তা ও আত্মম্ভরিতা, মেজর জেনারেল রাজাও তার শরিক। এই ঘোষণাটি আবার ঢাকায় দাঁড়িয়েই করার মধ্যে বাঙালি মুসলমানের সংবেদনশীলতার প্রতি যে গর্বিত উপেক্ষা ছিল, পাকিস্তানের জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের মানুষদের তা সহ্য করতে হয়। ইয়াহিয়া খানের মূর্খতা নয়, এই ধরনের ঘটনাই বাংলাদেশের জন্ম ঐতিহাসিক ভাবে অনিবার্য করে তুলেছিল।
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনানায়ক ও সামরিক-প্রশাসনিক আমলাদের দুষ্টুমি তুলনায় খাদিম হুসেন রাজার কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। ঢাকার সমস্যা মীমাংসায় ইয়াহিয়া খান তখন নিয়াজির মতো গভর্নরকে পাঠিয়েছেন, যিনি পৌঁছেই রাজার কাছে তাঁর বাঙালি ‘বান্ধবী’দের টেলিফোন নম্বর চান কিংবা বাঙালিদের শায়েস্তা করতে ওদের মহিলাদের গণধর্ষণ করার প্রস্তাব দেন। পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন পাক বাহিনীর প্রধান টিক্কা খান-এর শয়তানির কথাও ভোলা কঠিন। আর স্বয়ং ইয়াহিয়া খানের গভর্নরের প্রাসাদে রতিবিলাসে মত্ত হয়ে মুখ্য উপদেষ্টাদের অনন্ত কাল অপেক্ষা করিয়ে রাখার ইতিবৃত্তও কম রোমহর্ষক নয়। এই চটি আত্মকথাটি না পড়লে আমি বুঝতেই পারতাম না, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা-অফিসাররা কী ভাবে ঢাকাকে প্রাচ্যের ‘হীরা মণ্ডি’ বলে গণ্য করত। অস্বাভাবিক নয় যে, হুসেন রাজা পৌঁছনোর পরেই সামরিক কমান্ডার সাহিবজাদা ইয়াকুব খানের ডাকা এক বৈঠকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান বিনীত ভাবে জানতে চেয়েছিলেন— ‘পশ্চিম পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী ঠিক কবে নাগাদ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে যাবে?’ এই অতর্কিত প্রশ্নে সভাকক্ষে পিন-পতনের শব্দও শোনা যাবে, এমন নৈঃশব্দ্য ও নীরবতা। কারও মুখে কোনও কথা জোগায়নি। সেই প্রশ্নটা এখনও, এত বছর পরেও, রাজার কানে বাজে, যত দিন বাঁচবেন, তত দিন বাজবে। ওই প্রশ্ন থেকেই বোঝা গিয়েছিল, পুব-পশ্চিমের মেরুকরণ তত দিনে সম্পূর্ণ।
১৯৭০-এর ডিসেম্বরে আওয়ামি লিগ বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ’৭১-এর ১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে সোজা উড়ে যান লারকানায় পিপল্স পার্টির সভাপতি জুলফিকর আলি ভুট্টোর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনে একই রকম সাফল্য পেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন পাক সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আব্দুল হামিদ খান। এই ত্রয়ীর সিদ্ধান্তেই সামরিক অভিযান ‘অপারেশন ব্লিৎস’। ১ মার্চ ভুট্টোর পীড়াপীড়িতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের (পাক পার্লামেন্ট) উদ্বোধন স্থগিত করে দেন। তার আগেই ভুট্টো তাঁর দলের সাংসদদের ঢাকায় যেতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। (তাঁর নির্দেশ অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখান একমাত্র আহমদ রাজা কাসুরি, যার মাসুল গুনতে হয় তাঁর বাবাকে, ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তা হবার পর। সেই অপকর্মের মাশুল আবার ভুট্টোকেও গুনে দিতে হয় জিয়া-উল হককে, কাসুরিকে খুনের দায়ে নিজে ফাঁসিতে গিয়ে। ভারতে রাজনীতি করা এর চেয়ে অনেক সহজ।) ৬ মার্চ ইয়াহিয়া এক উস্কানিমূলক বেতার-ভাষণে যাবতীয় দোষ মুজিবর রহমানের ঘাড়ে চাপান। মুজিবের উপরেও স্বভাবতই চাপ বাড়তে থাকে, তাঁর ৭ মার্চের জনসভা থেকেই একতরফা ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করার। জেনারেল রাজার দাবি, ৬ মার্চ মুজিব নাকি দু’-দুবার তাঁর কাছে দূত পাঠান (যাঁদের নাম এখন আর তাঁর মনে নেই) তাঁকে ‘গ্রেফতার’ করে ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তায় সরিয়ে নিতে, যাতে তাঁর পারিষদ ও অনুগামীরা তাঁকে ছিঁড়ে না ফেলে।
বাস্তবে যেটা দেখা যায়, ব্যাপক প্ররোচনা সত্ত্বেও মুজিবরের ৭ মার্চের জনসভার বক্তৃতা কিন্তু ছিল আশ্চর্য রকমের সংযত। বস্তুত, সেই বক্তৃতাতেও মুজিবকে ‘পাকিস্তানকে যে কোনও মূল্যে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে’ এবং তিনি ‘বিভাজন চাইছেন না’, এ কথা দৃঢ় ভাবে ঘোষণা করতে শোনা যায়। মুজিবের এই সংযমের কৃতিত্ব জেনারেল রাজা নিজে দাবি করেছেন। তিনিই নাকি মুজিবরের দূতদের হুমকি দিয়েছিলেন, সামরিক অভিযানে জনসভা ভেঙে দিয়ে ঢাকাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে, আর তাতেই মুজিব নরম হয়ে যান। যদি সত্যিই তেমন হুমকি রাজা দিয়ে থাকেন, তবে অবশ্য জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে তাঁর আর তত পার্থক্য থাকে না, যে টিক্কা খানকে তিনি অত নিন্দেমন্দ করেছেন। মুজিবরের সংযম সত্ত্বেও টিক্কা খান পর দিন নরমপন্থী সেনাপতিদের সরিয়ে দেন। সপ্তাহখানেক পর ইয়াহিয়া খানকে বিমানবাহিনীর কমান্ডার সাফ জানিয়ে দেন, সামরিক অভিযান চালানো ঠিক হবে না। পত্রপাঠ তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইনামুল হককে এয়ার-কমোডোর নিযুক্ত করা হয়। ক’দিন আগে ভাইস-অ্যাডমিরাল এস এম আহসানও বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইস্তফা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে টিক্কা খানের নেতৃত্বে একটা সম্পূর্ণ নতুন ‘টিম’ যার পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ বা রাজনীতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই দায়িত্ব নিয়ে সামরিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হল। বীতশ্রদ্ধ জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানও তত দিনে ইস্তফা দিয়েছেন।
১৭ মার্চ রাজা ও তাঁর সহযোগী রাও ফরমান আলির কাছে মৌখিক নির্দেশ এল অভিযানের জন্য তৈরি থাকার এবং পরিকল্পনা বানানোর। নিশ্ছিন্তে ছক কষার অবসর পেতে রাজা তাঁর স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন এডিসিকে ব্যস্ত রাখতে। ১৮ মার্চ তাঁদের পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়, ২১ তারিখেই ভুট্টো এসে পৌঁছন। এ সময়েই নাকি তাঁর কয়েক জন সতীর্থ ঢাকায় সমবেত রাজনীতিক ও জেনারেলদের (ভুট্টো-ইয়াহিয়া-নিয়াজি-টিক্কা) গ্রেফতার করে ক্ষমতা দখল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জেনারেল রাজা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তাও করেন, শেষ পর্যন্ত কর্তব্যপরায়ণতায় অবিচল থাকার সিদ্ধান্তই নেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয় প্রদেশের সর্বোচ্চ পদের সেনা-অফিসার ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ধোঁকা দিয়ে। চট্টগ্রামের রেজিমেন্ট থেকে সরিয়ে তাঁকে সঙ্গে করে ঢাকায় এনে ‘অন্তরিন’ করা হয়, সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতে গোপনে পালান। ভুট্টোও তাঁর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ছে দেখে তৃপ্ত হয়ে সেই রাতেই বিমানে চড়েন। পর দিন মুজিবরকে গ্রেফতার করা হয়।
ও দিকে চট্টগ্রামে তরুণ মেজর জিয়া-উর রহমান (যিনি পরে মুজিবরকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর পরিবারের গণহত্যার কারণ হবেন) তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভুদের হত্যা করে ক্যান্টনমেন্টকে শহর থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রক্ষণাত্মক অবস্থানে নিয়ে যান। কাপ্তাই রোডে মোতায়েন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে তিনি বাঙালিদের বিদ্রোহ করতে আহ্বান জানান। জেনারেল রাজা অবশ্য অচিরেই ওই ট্রান্সমিটারের হদিশ পেয়ে যান, তাকে অকেজোও করে দেন। ‘স্বাধীন’ চট্টগ্রাম পুনর্দখল হয় ২৯ মার্চ, জিয়া-উর রহমানের তোলা বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু রাজার আর ঢাকায় থাকা হয় না। নিয়াজি, টিক্কা খান এবং ইয়াহিয়া মিলে তাঁকে পশ্চিমে পাঠিয়ে দেন। রাজা পরাজয়, অসম্মান ও গ্রেফতারির হাত থেকে বেঁচে যান।
|
|
বীরাঙ্গনা। তখনও পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ |
রাজার মতো পশ্চিম পাকিস্তানি সেনানায়ক ও রাজনীতিকরা পুবের বাঙালিদের মনে করতেন বুভুক্ষু, রুগ্ণ, অলস, অকর্মণ্য, সহজে উত্তেজিত হওয়া লোকজন। ‘অশিক্ষিতদের মতোই সহজে সব কিছু বিশ্বাস করে ফেলে’। খুব জোরে কেউ হেঁচে উঠলে কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়ে যায়। বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে এ রকম উন্নাসিক, আত্মগর্বী ধারণা নিয়েই আবার রাজার মতো সেনানায়করা পুবে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশাসনিক কর্তাদের অহমিকার সমালোচনা করেছেন। এ যেন চালুনির তরফে ছুঁচের ছিদ্রান্বেষণ! পশ্চিম পাকিস্তান যে পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশের মতো ব্যবহার করত, শোষণ-পীড়ন করত, এটা অনেকেই বুঝতে চায়নি। রাজা যেমন পুবে শিল্পায়নের ঘাটতি এবং পশ্চিমে তার বিস্ফোরণের তুলনা টেনেছেন। কিন্তু উন্নয়নকে আঞ্চলিক অসাম্য দূর করার কাজে কিংবা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যবহার করার কোনও তাগিদ তাঁদের নেই। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ঘাটতির ওপরেও তাঁরা জোর দেন। অথচ আজ স্বাধীন বাংলাদেশ কেন সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশের নিরিখে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে, তার কোনও ব্যাখ্যা তাঁদের নেই।
এঁরা যদি অর্থনীতিতে অজ্ঞ, ইতিহাসে তবে মা-সরস্বতী। রাজার মতে যেমন, পলাশির যুদ্ধের পর মুসলিমরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিল। মুঘলরা যে পলাশির পরেও ১০১ বছর দিল্লিতে রাজত্ব করেছে, এই তথ্য তাঁরা চেপে যান। চেপে যান এই ইতিহাসও যে, মুঘল আমলের সুবর্ণযুগেও অধিকাংশ মুসলমানকে অভিজাত, উচ্চবংশীয় আশরফি না-হওয়ার গ্লানি ও অসম্মান নিয়েই দিন গুজরান করতে হত। তাঁর ইতিহাস-অজ্ঞতা চরমে ওঠে যখন তাঁকে বলতে শোনা যায় যে ব্রিটিশরাই বাংলায় হিন্দু রাজা-জমিদারদের একটা শ্রেণি সৃষ্টি করে, যারা মুসলিম কৃষিজীবীদের দমন ও শোষণ করে। রাজা-জমিদারদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ভূস্বামী ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দিন, যিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল হন, যাঁর অধীনে মুসলিম রায়ত বা প্রজারা কিছু কম শোষিত, নিপীড়িত হতেন না। চেপে যাওয়া হয় হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ও মধ্য ভারতে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম ভূস্বামী-রাজা-জমিদারদের কথা। পাকিস্তানের পঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে মুসলিম জমিদারদের শোষণে অতিষ্ঠ ‘হারি’দের কথাও প্রসঙ্গত উঠবে।
এই ধরনের নিম্ন মানের সাম্প্রদায়িক ভাবনাই শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের ভাঙনের কারণ হয়ে ওঠে। ইসলাম একটা অভিন্ন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক যোগসূত্র সরবরাহ করলেও বাস্তব বিভেদগুলো ঘুচিয়ে দিতে পারেনি। ভাষা ও সংস্কৃতির বিভাজনগুলো ধর্মীয় ঐক্যবোধের চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। এ জন্য পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু সংখ্যালঘুদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। জেনারেল রাজার নিকৃষ্টতম ভাবনাটি অবশ্য এই প্রসঙ্গেই প্রকাশ হয়ে পড়েছে: ‘বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আর এ ব্যাপারে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে তথাকথিত বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষা’। পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর পরে এবং বাংলাদেশের জন্মেরও চল্লিশ বছর পরে ভারত, বাংলাদেশ, এমনকী পাকিস্তানের দক্ষিণ এশীয় বৈচিত্র্য অনুধাবনে এই অপারগতাই উপমহাদেশে মুসলিম স্বদেশ বিষয়ক পাকিস্তানের ধারণার সীমাবদ্ধতাকে প্রকট করে দেয়। পাক রাজনীতিক ও সেনানায়কদের ব্যক্তিগত বিচারধারা, উন্নাসিকতা, অহমিকার চেয়েও এই সীমাবদ্ধতাই রাষ্ট্রীয়তা হিসাবে পাকিস্তানের ব্যর্থতার কারণ।
জেনারেল খাদিম হুসেন রাজার জন্ম ১৯২২’এ। দেশভাগ তথা পাকিস্তানের জন্মের সময় তিনি ২৫ বছরের এক পূর্ণাঙ্গ, প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। ১৯৬৫ সালে যখন পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে নামে, তখন তিনি ৪৩ বছরের পরিপক্ব ফৌজি। ৪৭ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় নিযুক্ত হচ্ছেন। আজ তিনি আশির কোঠায়, তাদের দলে, যারা পাকিস্তানি হওয়ার আগে ‘ভারতীয়’ ছিল, ইদানীং যাদের ক্রমে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে বা তার অব্যবহিত আগে যারা জন্মেছিল, তারা বরাবরই পাকিস্তানি, ‘ভারতীয়’ হওয়ার অভিশাপ তাদের গায়ে লাগেনি। তাদের অনেকের মনেই জেনারেল রাজার সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি নেই। কারণ ভারতীয় নয় বলে তারা পাকিস্তানি, এমন নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে নিজেদের পাকিস্তানি সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। পাকিস্তানের এক প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কাসুরি সে দিন আমায় বলছিলেন— ৯০ শতাংশ পাকিস্তানি তাদের গোটা জীবনে এক জন হিন্দুও দেখেনি। তাদের মনে তাই হিন্দু ভারতের প্রতি কোনও বিরূপতা নেই। জেনারেল রাজা যেমন বলেছেন, ‘শত্রুরা এখনও হাল ছাড়েনি, অবশিষ্ট পাকিস্তানকে ভেঙে টুকরো করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে’! খাদিম রাজার মতো ডাইনোসরদের তাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে দুই জাতির মধ্যে সুস্থ ও যুক্তিপূর্ণ সম্পর্ক রচনার দিকে এগিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ ভারতীয়ই খাদিম রাজার ধারণা ও মনোভঙ্গিকেই একবিংশ শতকের পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বকারী ধারণা ও মনোভাব বলে বিশ্বাস করেন। এর চেয়ে বড় ভুল আর কিছু হতে পারে না।
|
আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি, ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-৭১।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা। ও ইউ পি, করাচি |
|
|
|
|
|