রাত পৌনে একটা। নাগেরবাজার উড়ালপুলের উপরে দাঁড়িয়ে আছি। সঙ্গী চিত্র সাংবাদিক। বেশ কিছু মোটরবাইক হুশহাশ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই উড়ালপুল নিয়েই গত কয়েক দিন ধরে একটা রটনা শোনা যাচ্ছে। তা সরেজমিনে দেখতেই সোমবার রাতে বেরিয়েছিলাম দু’জনে। দেড় ঘণ্টা ঘোরাঘুরি করেও ভূত তো দূর অস্ত, পুলিশেরও টিকি দেখতে পেলাম না। দেখলাম উড়ালপুলে নেশাড়ুদের উৎপাত। উটকো লোকের সন্দেহজনক চলাফেরা আর পড়ে থাকা মদের খালি বোতল।
প্রথম বার লেকটাউনের দিক দিয়ে উড়ালপুলে উঠেছিলাম। এগিয়ে দেখলাম, উড়ালপুলের রাস্তার আলো উধাও। নিকষ কালো অন্ধকার। তার মধ্যেই পরপর দুটো মোক্ষম বাঁক নিয়েছে রাস্তা। এই বাঁকেই তো একের পর এক মোটরবাইক দুর্ঘটনা ঘটছে গত কয়েক মাস ধরে। অবশ্য চোখের সামনেই যে ভাবে মোটরবাইক দৌড়তে দেখলাম, তাতে বোধ হয় দুর্ঘটনা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। |
দ্বিতীয় বার উড়ালপুলে হাঁটা শুরু করলাম সরোজিনী নাইডু কলেজের দিক দিয়ে। যত এগোচ্ছি, দেখছি রাস্তায় ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে জলের খালি বোতল আর সিগারেট-বিড়ির টুকরো। একটু দূরে ছোট একটি ট্রাকের চালক আর খালাসি নেশায় মত্ত। দু’জনেই একে অন্যকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য গালিগালাজও করছেন। খানিক দূরে আরও তিন মোটরবাইক আরোহী দাঁড়িয়ে। কাছে যেতেই বুঝলাম, তাঁরাও ‘স্বাভাবিক’ নন। উড়ালপুলের একাংশে সংকীর্ণ ফুটপাথ রয়েছে। সেখানেও ইতিউতি পড়ে মদের খালি বোতল।
কিছু দিন ধরে রটছে, এই উড়ালপুলে নাকি ভূতের দেখা মিলছে। উড়ালপুলে দাঁড়িয়ে সোমবার রাতের পরিস্থিতি দেখে মনে প্রশ্ন এল, ‘ভূত’ কী তবে সর্ষেতেই?
রাত দেড়টা। মোটরবাইক নিয়ে এক যুবককে উড়ালপুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, তাঁর নাম বিশ্বজিৎ শীল। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। বাড়ি কসবায়। রটনার কারণ খুঁজতে আমাদের মতোই হাজির তিনিও। প্রশ্ন করলাম, কী দেখলেন?
বিশ্বজিতের উত্তর, “মত্ত কিছু যুবকের আনাগোনা।” বুঝতে পারলাম, কেন এই রটনা। রাতের উড়ালপুলের ছবি মোবাইলে তুলে ফেসবুকে আপলোড করছিলেন ওই যুবক।
রাত পৌনে দুটো। ছোট ট্রাক-মোটরবাইক নিয়ে যুবকদের আনাগোনা বাড়ছে। চালকদের অনেকেই উড়ালপুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আর ছোট প্রাইভেট গাড়িগুলি ঝঞ্ঝাট এড়াতে তলার রাস্তা ধরছে। এক ঘণ্টা হল, এই এলাকায়। পুলিশের টহলদারি গাড়ি কিন্তু নজরে এল না। উড়ালপুল জুড়ে নেশাগ্রস্তদের আনাগোনা। |
রাত দুটো। উড়ালপুলের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম অন্ধকার জায়গাটায় একটা বোলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির ভিতরের কথা বাদই দিলাম। খোলা রাস্তায় নেমে মদের বোতল হাতে নেচে চলেছে এক দল যুবক। ভাল করে নজর করতে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। আশপাশ দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মোটরবাইক আরোহী ওই অন্ধকার জায়গাটাতেই এসে দাঁড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকে হাত দেখিয়ে থামানোরও চেষ্টা করছে। মিনিট পনেরো বাদে অন্ধকার জায়গাটার দিকে এগোতে শুরু করলাম। উড়ালপুলের আশপাশে অধিকাংশ বহুতলের জানালাগুলো বন্ধ। বোলেরো গাড়িটা তখনও দাঁড়িয়ে। নেশাড়ুদের হুল্লোড়ও তখনও কমেনি। সঙ্গের চিত্র সাংবাদিক তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করতেই রে রে করে তেড়ে এল কয়েক জন।
দমদম থানার পুলিশের দাবি, তাদের টহলদারি জিপ ছাড়া উড়ালপুলের কাছে কামারডাঙা ফাঁড়ির গাড়িও এই উড়ালপুলে টহল দেয়। মোটরবাইকেও টহল চলে। এ ছাড়াও উড়ালপুলের দু’দিকে পুলিশ থাকে। মত্ত গাড়িচালককে ধরতে পারলে উড়ালপুলে ওঠার আগেই আটকানো হয়। তবে সোমবার রাতে ঘণ্টা দুয়েকের টহলদারিতে কেন পুলিশের দেখা পাওয়া গেল না, তার অবশ্য উত্তর মেলেনি।
তবে ফেরার সময়েও পুলিশের কোনও গাড়ি চোখে পড়েনি। রটনা শুনেছিলাম। কিন্তু তার পিছনের ছবিটা যে এ রকম, তা ভাবিনি। উড়ালপুলের তলাতেই দেখলাম পুলিশের একটা ফাঁড়ি। আর তার নাকের ডগাতেই বসছে মদ্যপায়ীদের আসর।
কেউ এ বার বলতেই পারেন, ‘ভূতেদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল!’
|