|
|
|
|
রাজ্যের পুরাকীর্তিতে নয়া জিয়নকাঠি |
অলখ মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
দেবতার জন্মের কাহিনি রয়েছে, এ বার পুনর্জন্মের অপেক্ষা।
হুগলির গুড়াপ সেই অপেক্ষাতেই আছে। এক সময় জন্মাষ্টমীর রাতে গুড়াপ যেন জেগে উঠত বৃন্দাবন হয়ে। বর্ধমানের মহারাজের দেওয়ান রামদেব নাগের প্রতিষ্ঠিত নন্দদুলাল মন্দিরের প্রাঙ্গণ ভরে উঠত। এক পাশে দোলমঞ্চ, এক পাশে রাসমঞ্চ নিয়ে সেই মন্দির পরে হারিয়েই গেল স্মৃতি থেকে। এখন আবার নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠার পালা। গুড়াপের বাসিন্দা কালীপদ সিংহ বা শম্ভুনাথ দালালের কথায়, “তাতে ইতিহাসের দায় মিটিয়েও হাতে থাকে আরও কিছু।”
যেমন, চণ্ডীতলার বাকসায় ছিল সরস্বতীর তীরে পর্তুগিজদের ছোট বন্দর। সেখানেই দেওয়ান ভবানীচরণ মিত্রের পরিবার তৈরি করেছিল দ্বাদশ শিবমন্দির। অনুমান করা যায়, জমজমাট এক নগরীই ছিল তখন এই এলাকা। এখানকার রঘুনাথ মন্দিরও বিখ্যাত। গায়ে গায়েলাগোয়া শিব, কৃষ্ণ, রাধারানির মন্দির তখন হুগলির এই অঞ্চলে ছড়িয়ে। এক এক করে সরস্বতীর মতোই মজে গিয়েছে সেই ধারা। সেই সঙ্গে মুছে গিয়েছে সে কালের চিহ্নগুলিও, কারণ, এই স্থাপত্যগুলির গঠনরীতি, গায়ের পোড়ামাটির কারুকাজের চরিত্রগুলি থেকে সে কালের সমাজজীবন সম্পর্কে ধারণাও তৈরি করে দেয়। সংস্কার করে সেই স্থাপত্যের পুনর্নির্মাণ তাই ফিরিয়ে দেবে সে কালের সেই ছবিও। |
|
সারা রাজ্য জুড়েই পুনর্জন্মের প্রতীক্ষায় রয়েছে এমন অজস্র সব পুরাকীর্তি। ভেঙে যাওয়া মন্দির বা মসজিদ, কোথাও হানাবাড়ির মতো পড়ে থাকা প্রাসাদ, কোথাও প্রাচীন বন্দরের অবশেষ। এক সময় যা ছিল সমৃদ্ধ জনপদের আবশ্যিক অঙ্গ, দীর্ঘ অবহেলায় তা হারিয়ে গিয়েছে বাঙালির ইতিহাসের অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান সঙ্গে নিয়ে। সেই শাপমোচনের লক্ষ্যেই পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও সংস্কারে ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজ্য সরকার। রাজ্য প্রত্ন দফতরের অধিকর্তা তথা রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সচিব ক্ষুদিরাম দাস বলেন, “ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের টাকা থেকে চার বছর ধরে এই কাজগুলি করা হবে। প্রাথমিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করছি ভেঙে পড়া পুরাকীর্তিগুলো কী অবস্থায় ছিল। সমীক্ষা করানোর পরে আমরা সেই পুরাকীর্তিগুলিকে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।” রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীও এই কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, “সব দিক খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো কাজ করব।”
পুরো প্রকল্পটিকে তিন ভাগে ভাঙা হয়েছে। প্রথম পর্বে কী কী পুরাকীর্তি রয়েছে, তা রেকর্ড করা হচ্ছে। পুরাকীর্তির বর্তমান অবস্থার ছবি তোলা হচ্ছে, ড্রয়িংও হচ্ছে। তার সঙ্গে তৈরি হচ্ছে কাছাকাছি রেল স্টেশন বা জাতীয় সড়ক বা রাস্তা যা রয়েছে, তার মানচিত্র। দ্বিতীয় পর্বে, কোন স্থাপত্য কী ভাবে সংস্কার হবে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মতো তা স্থির করে ফেলা হচ্ছে। তৃতীয় পর্বে, যাঁরা এই কাজ করবেন, তাঁদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে ভারতের নানা জায়গা থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হচ্ছে। তাঁরা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কী ভাবে কোন কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যেই তেমন দু’টি কর্মশালা হয়ে গিয়েছে।
হেরিটেজ কমিশনের প্রকল্প অধিকর্তা পার্থ দাস জানাচ্ছেন, কোনও পুরাকীর্তিকে তার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়াটাই আসল চ্যালেঞ্জ। সাধারণত, এই ধরনের স্থাপত্য নানা সময়ে নানা ভাবে সংস্কার করা হয়। তাতে যে প্রলেপ পড়ে, তাতে লুকিয়ে পড়ে মূল রূপটি। একই নিঃশ্বাসে ইতিহাসবিদেরা এ কথাটাও বলেন যে, অনেক সময়ে দেখা যায়, ওই প্রলেপটিরও পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব রয়েছে। যে কারণে কোনও কোনও স্থাপত্যে নানা ধারার শৈলীর মিশেল দেখা যায়। তাই কতটুকু রাখা হবে, কতটুকু ফেলা হবে, তার হিসেব কষতে
হবে নিখুঁত ভাবে। অর্থাৎ সংস্কারের আগে পুরাকীর্তিটির ইতিহাস আবিষ্কার থেকেই কাজের শুরু। পার্থবাবু জানান, সে কাজ তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন। যতটা পারা যাচ্ছে প্রতিটি পুরাকীর্তির ছোট ইতিহাসও তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি জেলায় এই ব্যাপারে আলাদা করে বই তৈরি হবে। তৈরি হবে একটি ওয়েবসাইটও। যাতে বিশেষজ্ঞরা সহজে যে কোনও জায়গা থেকে সেই পুরাকীর্তিটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিতে পারেন।
|
১০০ কোটির সংস্কার |
• পুরনো প্লাস্টার খসিয়ে, গা বেয়ে গজিয়ে ওঠা গাছপালা সাফ করা হবে।
• প্রয়োজন মতো নতুন প্লাস্টার।
• স্থাপত্যের সঙ্গে মানানসই করে ফাঁকফোকর ভরাট।
• পুরনো কালের মতো করে মশলা মেখে ক্ষয়ে যাওয়া কারুকাজ নতুন করে নির্মাণ করা হবে।
• পাকা নিকাশি ব্যবস্থা নির্মাণ। যেখানে সুযোগ রয়েছে, সাজানো হবে এলাকা। |
|
সম্প্রতি হেরিটেজ কমিশনের একটি কর্মশালায় এসেছিলেন ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের হায়দরাবাদ মণ্ডলের রসায়ন বিশেষজ্ঞ সুরজিৎ মাইতি। তিনি জানান, পুরনো স্থাপত্যকে যতটা সম্ভব বাঁচিয়ে সংস্কারের কাজ করতে হবে। পুরাকীর্তির গা বেয়ে গজিয়ে ওঠা আগাছা যেমন তেমন ভাবে টেনে-উপড়ে ফেললে হবে না। তার গোড়ায় বিশেষ রাসায়নিক দিতে হবে। যাতে তা স্থাপত্যের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করেই নির্মূল হয়ে যায়। তিনি বলেন, “সেই পদ্ধতিগুলিই কর্মশালায় বোঝানো হয়েছে।”
এই বিপুল কর্মযজ্ঞের কিছু কাজ ইতিমধ্যেই এগিয়েছে। যেমন গুড়াপের নন্দদুলাল মন্দির এবং চণ্ডীতলার বাকসার বারো শিবের মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, পুরো এলাকাটি সংরক্ষণ করতে বিভিন্ন মন্দিরের ছাদ, দেওয়াল থেকে মেঝে সবই সংস্কার করতে হবে। তৈরি করতে হবে নিকাশি ব্যবস্থা। মোট খরচ পড়বে ১২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৬৭ টাকা। বাকসার বারো শিবের আটচালা ঢঙের মন্দিরগুলির সব ক’টিরই উচ্চতা ৬০ ফুট। রয়েছে রঘুনাথ মন্দিরও। মন্দিরগুচ্ছের সংস্কারে সব মিলিয়ে ২৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩৯৫ টাকা খরচ হবে।
প্রথম দফায় মোট ৭৪টি পুরাকীর্তি সংরক্ষণ ও সংস্কার হবে। দ্বিতীয় দফায় হবে ২৪টি। তৃতীয় এবং চতুর্থ দফায় তালিকায় রয়েছে ১৯টি পুরাকীর্তির নাম। এর মধ্যে কিছু রাজ্য সরকার অধিগৃহীত, কিছু হেরিটেজ কমিশনের তালিকাভুক্ত, কিছু একেবারেই সংস্কার হয়নি। পার্থবাবু জানান, এই পুরাকীর্তিগুলির প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার। তার পরে বিশেষজ্ঞেরা সমীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কোন কাজটা আগে করা হবে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব দফতরের উপ অধিকর্তা অমল রায় বলেন, “আবহাওয়ার কারণে এ রাজ্যে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ।” যেখানেই ইট ও চুন-বালি রয়েছে, সেখানে জল ঢুকে স্থাপত্য ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই কারণেই পোড়ামাটির শিল্প ক্ষয়ে যায়। অমলবাবু বলেন, “পুরাকীর্তি সংস্কারের জন্য সে কালে ইট ও চুন-বালির পুরনো মশলা যে ভাবে তৈরি হত, সে ভাবেই এখন নতুন করে ইট ও মশলা তৈরি করা হবে।”
এ-ও তো এক পুজো। দেবতাদেরও তাই পুনর্জন্ম হয়।
|
নজর যেখানে |
• প্রথম দফায়— ব্যান্ডেল চার্চের কাঠের মাস্তুল, বর্ধমানের নূতনহাটের হুসেন শাহী মসজিদ, পূর্ব মেদিনীপুরের ডিহি বাহিরির জগন্নাথ মন্দির,
মালদহের তুলাভিটার বৌদ্ধমঠ, হুগলির পেঁড়োতে ভারতচন্দ্রের ভিটে।
• দ্বিতীয় দফায়— কোচবিহারের বাণেশ্বর শিবমন্দির, হুগলির শ্রীরামপুরের হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা, বেলেঘাটার মসজিদ, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ি, বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ।
• তৃতীয় ও চতুর্থ দফায়— জাঙ্গিপাড়ার হরিরামপুরের শিবমন্দির, পুরুলিয়ার জৈন মন্দিরগুচ্ছ, আলিরপুরদুয়ারের বক্সা দুর্গ, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির দণ্ডেশ্বর মন্দির, বাঁকুড়ার ওন্দার সূর্যমন্দির, বর্ধমানের কালনার মসজিদ। |
|
* তালিকা অসম্পূর্ণ |
|
ছবি: প্রকাশ পাল |
|
|
|
|
|