দমবন্ধ অন্ধকারে কাচ ভাঙার চেষ্টা
ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে দুম করে শব্দ। থমকে গেল ট্রেন। গলগল করে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ।
অন্ধকূপে নির্ঘাত মৃত্যু, ভেবে নিয়েছেন যাত্রীরা। আতঙ্কে পরিত্রাহি চিৎকার করছেন! কেউ ভাঙছেন জানলার কাচ, কেউ মরিয়া হয়ে দরজায় ধাক্কা মারছেন! দু’একটা টিমটিমে নীল আলো শুধু তাকিয়ে রয়েছে ভূতের মতো।
১০ মিনিট নাকি গোটা একটা প্রহর!
বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ দিক থেকে মহাত্মা গাঁধী রোড মেট্রো স্টেশনে যখন ট্রেনটা এসে থামে, তখনও কোনও গোলমাল ছিল না। ৮টা ৫৯ মিনিটে সিগন্যাল সবুজ হল। ট্রেনও পাতালে নামল! তার পরেই ব্ল্যাক আউট! ইঞ্জিন-সহ চারটি কামরা তখন সবে প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে।
অন্ধকারে আগ্রাসী ধোঁয়া আর মৃত্যুভয়ে দম আটকে যাওয়া দশ-দশটা মিনিট কী ভাবে কাটল, কেউই বলতে পারবেন না পুরোটা। শুধু হঠাৎ দেখবেন, সুড়ঙ্গের মধ্যেই খুলে গেল কামরার দরজা। বাইরের বাতাস ঢুকল। যাত্রীরা বুক ভরে শ্বাস নিলেন, জীবনের স্পর্শ পেলেন।
প্রথম কামরাতেই ছিলেন রূপা ঘর। “বলতে পারব না ধোঁয়াটা কামরার ভিতর থেকে আসছিল নাকি বাইরে থেকে। কারণ কামরা অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু কয়েকটা নীল আলো টিমটিম করছিল।” যাত্রীদের চিৎকার শুনে চালক এক বার আশ্বস্ত করার চেষ্টাও করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আপনারা ভয় পাবেন না। তেমন কিছু হয়নি।’’ কিন্তু ভিড়ে ঠাসা অন্ধকার কামরা তখন গিলে খাচ্ছে ধোঁয়া। আচমকা যখন দরজা খুলল, তখন আর এক প্রস্ত আতঙ্ক! তাহলে কি এ বার সুড়ঙ্গে লাফ দিতে হবে? শোনা গেল চালকের ঘোষণা, “আপনারা আস্তে আস্তে পিছনের দিকে চলে যান। প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়বেন।” আস্তে আস্তে যাওয়ার মতো অবস্থায় কেউ নেই তখন অবশ্য। রূপাদেবী বলেন, “পড়িমড়ি করে ছুটে পঞ্চম কামরা দিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ি।”
বিপর্যয়ের পরে। ধোঁয়ার কারণ খুঁজতে ডাকা হয়েছিল দমকলকেও। ছবি: সঞ্জয় ঘোষ
প্রথম চারটি কামরা না হয় সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছিল। আতঙ্কে কাঁপছিলেন বাকি কামরার যাত্রীরাও। ছ’নম্বর কামরায় ছিলেন লেকটাউনের বাসিন্দা গৌরব বাগারিয়া। বললেন, “আওয়াজ হতেই ট্রেনটি দাঁড়িয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর আবার চলতে শুরু করে ফের দাঁড়িয়ে যায়। এ বারই দেখলাম, কামরার বাইরের দিক থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।” যাত্রীরা চিৎকার জুড়ে দেন, ‘দরজা খুলে দিন’, ‘দরজা খুলে দিন’। তাঁদের আওয়াজ যদিও ট্রেনচালক পর্যন্ত পৌঁছয়নি। রেলের কোনও কর্তাও নেমে আসেননি প্ল্যাটফর্মে। অগত্যা একের পর এক দরজা ভাঙতে শুরু করেন যাত্রীরাই। গৌরব বলেন, “আমিও কাচের দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসি।”
১৯৮৪-র অক্টোবরে চালু হয়েছিল কলকাতা মেট্রো। এই প্রথম যাত্রীদের দরজা ভেঙে বেরোতে হল। কীসের জেরে এই বিপর্যয়? মেট্রো সূত্রের খবর, রেকের সুইচ গিয়ারের গোলমাল হয়েছিল। মেট্রোর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার প্রত্যুষ ঘোষ বলেন, “এই দুর্ভোগের জন্য ক্ষমা চাইছি।” তিনিই জানান, পিছনে আরও ট্রেন আটকে থাকায় মেট্রো চালানো যায়নি। ফলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায় ৯টা দু’মিনিট থেকেই।”
মাস তিনেক আগেই রেলমন্ত্রী ঘটা করে নোয়াপাড়া কারশেডে একটি কারখানা উদ্বোধন করে বলেছিলেন, পুরনো রেকের খোলনলচে পাল্টানো হবে। সেটা যে প্রতিশ্রুতিই, মালুম পাচ্ছেন যাত্রীরা। রেল সূত্রের খবর, ১১টি কোচের কর্মক্ষমতার সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রেক কম থাকায় সেগুলিকে বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। পুরনো রেকে ব্রেক শু ঠিক মতো কাজ করে না। দরজা বন্ধ না হওয়ার সমস্যা তো আছেই। তবে প্রত্যুষবাবু দাবি করছেন, বছর বছর প্রতিটি কোচ ভাল করে পরীক্ষা করা হয়। সুরক্ষা ছাড়পত্র ছাড়া কোনও রেক চলে না। ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর পুজোর রাতে গিরীশ পার্ক স্টেশন ছাড়ার পরে সুড়ঙ্গের মধ্যে আটকে পড়েছিল মেট্রো। মোটরম্যানের কেবিনে মই লাগিয়ে যাত্রীদের নামানো হয়েছিল। ওই বছরই ২০ অক্টোবর মেট্রোর দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়। কিন্তু কোনও বারেই বৃহস্পতিবার রাতের মতো এই পরিমাণ আতঙ্ক ছড়ায়নি। অনেকেই বলছেন, সব ক’টি কামরা পাতালে থাকার সময় এমন হলে কী হত?
বৃহস্পতিবারের পরে নিত্যযাত্রীদের অনেকেরই আত্মবিশ্বাস টলে গিয়েছে। দমদমের ভবতোষ সেনগুপ্ত যেমন। বললেন, “যত বার মেট্রোয় উঠব এই স্মৃতি তাড়া করবে। আর একটু হলে ভয়েই মারা যেতাম!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.