ক্যানসার জয় করেও ডোপিংয়ে হেরে গেল রূপকথা
তাঁর আত্মজীবনী ‘ইটস নট অ্যাবাউট দ্য বাইক’-এ ল্যান্স আর্মস্ট্রং লিখেছেন, ‘বিদ্রুপ সব সময়ই হাততালির চেয়ে বেশি জোরে বাজে!’
হয়তো সত্যিই বাজে। আজ শিখরচ্যুত হওয়ার পরে নতুন করে এই অনুভূতি নিশ্চয়ই সাইক্লিং দুনিয়ার এই জীবন্ত কিংবদন্তিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যিনি ছিলেন রূপকথার মহানায়ক, মারণরোগ জয় করে এসে টানা সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রাঁসের মতো টুর্নামেন্টজয়ী, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার মনের জোর পেতে যুবরাজ সিংহ যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন (তিনিও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান যুবরাজকে), সেই মানুষটিই রাতারাতি ডোপিংয়ের দায়ে কলঙ্কিত, বহিষ্কৃত, ধিক্কৃত। নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছেন চিরতরে। ১৯৯৮ সাল থেকে যাবতীয় পুরস্কার, পদক, খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। খসে পড়েছে রাজার মুকুট। সব থেকে বড় কথা, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে সযত্নে লালিত অতিমানবিক, কিংবদন্তিসুলভ ভাবমূর্তি।
পারফরম্যান্স বাড়িয়ে তোলা নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগ আর্মস্ট্রংয়ের বিরুদ্ধে আজ নতুন নয়। ’৯৯-এ প্রথম বার খেতাব জয়ের সময়েও ছিল। কিন্তু সে অভিযোগ দানা বাঁধেনি। আল্পসের কঠিনতম চড়াইয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতার সীমা নির্ধারণের যে সর্বোচ্চ পরীক্ষা চলে, তাতে সাত বার জয়ী আর্মস্ট্রংয়ের বিরুদ্ধে গত জুনে নতুন করে অভিযোগ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডোপিং নিরোধক সংস্থা ‘উসাডা’। দাবি ছিল, ’৯৯ থেকে ডোপিং করছেন এবং তাঁর ত্যুর জয়ী দলে এর নেতৃত্বও দিয়েছেন।
প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করে আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। বিচারের পদ্ধতিকে ‘একপেশে ও অনৈতিক’-ও বলেছিলেন। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে গত রাতে। এক বিবৃতিতে ৪১ বছর বয়সি মার্কিন সাইক্লিস্ট বলে দেন, “প্রত্যেক মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন তাঁকে বলতে হয়, অনেক হয়েছে, আর নয়। আমার কাছে এখনই সেই সময়।”
ল্যান্স আর্মস্ট্রং
মার্কিন সাইক্লিস্ট
জন্ম ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর
১৯৯৬-এ অণ্ডকোষের ক্যানসার ছড়ায় তলপেট, ফুসফুস ও মস্তিষ্কে
তিন বছর পরে ক্যানসার থেকে ফিরে ত্যুর দ্য ফ্রাঁস জয়
’৯৯-২০০৫, টানা সাত বার ত্যুর দ্য ফ্রাঁসে সেরা
অবসর ভেঙে ফিরে ২০০৯-এ তৃতীয়
ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে ’৯৭-এ গড়া ‘ল্যান্স আর্মস্ট্রং ফাউন্ডেশন’
১৫ বছরে তুলেছে ৫০০ কোটি ডলার
লিখেছেন বিশ্ব জুড়ে বেস্টসেলার ‘ইটস নট আবাউট দ্য বাইক’ ও ‘এভরি সেকেন্ড কাউন্টস’
জুন, ২০১২ সতীর্থদের সাক্ষ্য, ’০৯ সালের রক্তের নমুনার ভিত্তিতে
ডোপিংয়ের অভিযোগ আনে মার্কিন ডোপিং নিরোধক সংস্থা ‘উসাডা’

২৩ অগস্ট, ২০১২ অভিযোগের বিরুদ্ধে আর্মস্ট্রংয়ের না লড়ার সিদ্ধান্ত।
২৩ অগস্ট, ২০১২ আর্মস্ট্রংয়ের সাতটি খেতাবই কাড়ার সিদ্ধান্ত।
উসাডার অভিযোগের বিরুদ্ধে সুইৎজারল্যান্ডের লুসানে খেলাধুলোর সর্বোচ্চ আদালতে যেতে পারতেন আর্মস্ট্রং। কিন্তু সেই রাস্তা নেননি তিনি। জানিয়েছেন, এই অভিযোগে মানসিক ভাবে জর্জরিত হতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে, ক্ষতি হয়েছে তাঁর গড়া ক্যানসার ফাউন্ডেশনের কাজে। এই ‘ননসেন্স’ টানাপোড়েন তাঁর জীবনে আর কোনও অর্থ বহন করে না। ‘উসাডা’ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে তাঁর সাতটি ‘ত্যুর দ্য ফ্রাঁস’ খেতাব, ২০০০ এর সিডনি অলিম্পিকে জেতা ব্রোঞ্জ, এমনকী সেই ’৯৮ থেকে জেতা বিভিন্ন টুর্নামেন্টের খেতাব, সম্মান ও পুরস্কার অর্থ সব কেড়ে নেওয়া হল। খেলার জগৎ থেকে চিরতরে নির্বাসিত আর্মস্ট্রং করতে পারবেন না কোচিংও। উসাডা-র চিফ এগজিকিউটিভ ট্র্যাভিস টাইগার্ট বলেছেন, “গোটা বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমী জনতা এবং যাঁরা অ্যাথলেটিক্সের হিরোদের ভালবাসেন, সকলের কাছে আজ বড় দুঃখের দিন। যে কোনও মূল্যে জেতার সংস্কৃতি কতটা হৃদয়বিদারক হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত এই ঘটনা।” বারবার আর্মস্ট্রং বলে এসেছেন, তিনি কখনও ডোপ পরীক্ষায় ‘পজিটিভ’ হননি। কিন্তু দেখা গিয়েছে, ’৯৯-এর ত্যুর দ্য ফ্রাঁসের সময় তিনি এক বার ‘পজিটিভ’ হয়েছিলেন। তখন পুরনো তারিখের প্রেসক্রিপশন দিয়ে রেহাই মিলেছিল।
আর্মস্ট্রং সাফ বলছেন, “ওরা যাই বলুক, কোনও প্রমাণ ওদের নেই।” উসাডা আবার বলছে, তাদের কাছে অন্তত দশ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান রয়েছে। তাঁরা স্বীকার করেন, আর্মস্ট্রং রেস জিততে শরীরে অন্যের রক্ত নেওয়া, রক্তের কোষ বাড়ানোর চেষ্টা, টেস্টোটেরন-সহ অন্যান্য নিষিদ্ধ ওষুধ ও পদ্ধতির ব্যবহার করেন। আর্মস্ট্রংয়ের একদা ঘনিষ্ঠ সঙ্গী জর্জ হিনক্যাপিও নাকি তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।
ত্যুর দ্য ফ্রাঁস
• কবে শুরু?
ফ্রান্সে, ১৯০৩ সালে। ফরাসি সাময়িকপত্র ‘লোতো’-র বিক্রি বাড়াতে।
• কোথায় হয়?
শুরু ফ্রান্সে। পেরোতে হয় সুইৎজারল্যান্ড-সহ বেশ কিছু দেশ। পথে পড়ে আল্পসের দুর্গম চড়াই। শেষ প্যারিসের সঁজে-লিজে-তে।
• সময় ও দূরত্ব?
২১ দিনে ৩২০০ কিমি। দু’দিন বিশ্রাম। তুলনা করা হয় টানা ৩ সপ্তাহ ম্যারাথন বা ৩ বার এভারেস্টে ওঠার সঙ্গে।
• টিমের সংখ্যা?
২০ বা ২২, প্রতি টিমে থাকেন ৯ জন সাইক্লিস্ট। জয়ীকে ইউরোপে ‘মাস্টার অফ দ্য মাউন্টেন্স’ বলা হয়।
সাইক্লিংয়ের দুনিয়ায় ডোপিংয়ের দায়ে নির্বাসন নতুন নয়। ত্যুর দ্য ফ্রাঁস জয়ী মার্কিন সাইক্লিস্ট ফ্লয়েড লরিস এবং স্পেনের অ্যালবার্টো কন্টাডরের নামেও এই অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তাঁরা কেউই আর্মস্ট্রং নন। ২৫ বছর বয়সে অন্ডকোষের ক্যানসারের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে ফিরে আসা আর্মস্ট্রং বলেছেন, “আমি জানি কে ওই সাতটা ‘ত্যুর দ্য ফ্রাঁস’ জিতেছিল। আমার টিমমেটরা জানে কে জিতেছিল আর আমার প্রতিপক্ষরা জানে কে জিতেছিল। এটাই বিশ্বের কঠিনতম ইভেন্ট এবং শারীরিক সক্ষমতার দিক থেকে সেরা লোকটাই জেতে। কেউ এটা বদল করতে পারে না।”
ডোপিংয়ের দায়ে কিংবদন্তির নির্বাসনের দৃষ্টান্তও বিশ্বে কম নেই। ’৮৮-এর সোল অলিম্পিকে বেন জনসন, ’৯৪ বিশ্বকাপে মারাদোনা, ২০০০-এর সিডনি অলিম্পিকে মারিয়ন জোন্স, ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে শেন ওয়ার্ন। নির্বাসিত মারাদোনা বলেছিলেন, “ফিফা আমার দুটো পা-ই কেটে নিল।” শেন ওয়ার্নের প্রশ্ন ছিল, সর্দির ওষুধের সঙ্গে লেগস্পিন করানোর কী সম্পর্ক।
আর্মস্ট্রং কী বলতে পারেন? আবার চলে আসে তাঁর আত্মজীবনী, যেখানে ডোপ পরীক্ষা নিয়ে আর্মস্ট্রং লিখেছেন, ‘অনন্ত পরিশ্রম, ত্যাগ আর ফোকাস কখনও ল্যাবরেটরির কোনও পরীক্ষায় ধরা পড়ে না, সম্ভব নয়।’
তবু সেই পরীক্ষাই শিখর থেকে ছিটকে দিল তাঁকে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.