পরিকাঠামো বেহাল
সমস্যার ‘শেফিল্ড’
মস্যা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। আজও সমান তালে পাল্লা দিয়ে সেই সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে এক সময়ের ‘ভারতের শেফিল্ড’ হাওড়া শিল্পাঞ্চলে বন্ধ হয়েছে একের পর এক কারখানা। আর যে সব ক্ষুদ্র কলকারখানা চলছে সেগুলিও প্রশাসনিক জটিলতায় ও অনুন্নত পরিকাঠামোর জন্য ধুঁকছে বলেই অভিযোগ শিল্পপতিদের।
আর এই বিবিধ সমস্যা থেকে বাঁচতেই জগৎবল্লভপুরে একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কাজ শুরু করেছে হাওড়া বণিকসভা। এখানে একই ছাদের তলায় প্রাথমিক ভাবে গড়ে উঠবে তিনশোটি শিল্প। কিন্তু সেখানেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়ায় আশঙ্কায় দিন কাটছে ক্ষুদ্র শিল্পপতিদের।
শিল্পাঞ্চল হাওড়ায় মূল সমস্যা কী?
অধিকাংশ শিল্পপতির উত্তর একটাই বেহাল পরিকাঠামো। যার উন্নয়নের জন্য বছরের পর বছর স্থানীয় প্রশাসন থেকে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও কোনও ফল মেলেনি। উল্টে দিনের পর দিন সমস্যা বেড়েছে। বণিকসভার দাবি, কয়েক দশক আগেও হাওড়ায় মোট শিল্পের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। সেখানে বর্তমানে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজারে।
কী সেই সমস্যা?
শিল্পপতিরা জানান, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছে, ফাউন্ড্রি, রোলিং মিল, অ্যালুমিনিয়াম, ফোরজিঙ্ক প্রভৃতি কারখানা থেকে হাওড়া শহরে ব্যাপক দূষণ ছড়াচ্ছে। তাই সেখানে কারখানা চালাতে গেলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আরোপিত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে, না হলে বর্তমানে শহরাঞ্চলে আর নতুন কোনও কারখানা খোলার অনুমতি মিলবে না। পাশাপাশি, যে সব কারখানাকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ‘রেড ক্যাটাগরি’তে চিহ্নিত করেছে তাদেরকেও কারখানা সম্প্রসারণ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এক ক্ষুদ্র শিল্পপতির কথায়: “দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে বলছে তা কেনার ক্ষমতা আমাদের অনেকেরই নেই। তাই কারখানা বাড়াতে চাইলেও পারছি না।”
রয়েছে আরও নানা সমস্যা। যেমন, শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়। ভাঙাচোরা, ঘিঞ্জি, কোথাও আবার বড় বড় গর্ত। এখান দিয়ে সহজে কোনও গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। ফলে মালপত্র আনা-নেওয়া নিয়ে সমস্যা লেগেই থাকে। রয়েছে বর্ষাকালে জল জমার সমস্যা। অধিকাংশ কারখানা জলবন্দি হয়ে পড়ে। কারখানার ভিতরে জল ঢুকে মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময়ে শ্রমিক বা ক্রেতা, কেউই আসতে পারেন না। এই জল বেশ কিছু দিন ধরে জমে থাকে। পুরসভাকে বহু বার বলা সত্ত্বেও আজও এই চিত্রের পরিবর্তন হয়নি বলে অভিযোগ।
বিদ্যুতের সমস্যাও রয়েছে। অধিকাংশ সময়েই প্রয়োজনের তুলনায় ভোল্টেজ অনেক কম থাকে। বিদ্যুতের বিলও বেশি হয়। হাওড়া বণিকসভার এক সদস্য জানান, হাওড়া থেকে অন্যান্য রাজ্যে মালপত্র পাঠানো অত্যন্ত সহজ। কিন্তু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন না হওয়ায় মাল পরিবহণে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের। শিল্পপতিদের আরও অভিযোগ, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে সহজে কাজ হলেও নিচুতলার কিছু কর্মীর গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জন্যও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে কারখানা মালিকদের। যেমন, লিলুয়া এলাকার ছোট একটি কারখানার মালিক বিশু সাউ বললেন, “কারখানার মালিক থেকে শ্রমিক, আমি নিজেই সব। সেখানে দীর্ঘ দিন ধরে যদি আমাকে একটা কাজের জন্য প্রশাসনিক দফতরে ঘুরে বেড়াতে হয়, তবে কারখানায় কাজ করব কী করে?”
আবার শিল্পায়নের লক্ষ্যে সরকারের ‘এক জানালা নীতি’ও হাওড়ায় তেমন ভাবে কার্যকরী হচ্ছে না বলেই অভিযোগ হাওড়া বণিকসভার সভাপতি শঙ্কর সান্যালের। তিনি বলেন, “এর ফলে শিল্প সমস্যার প্রকৃত কোনও সমাধান হচ্ছে না।”
হাওড়া বণিকসভা সূত্রে খবর, জগৎবল্লভপুরে তিনশো জন ক্ষুদ্র শিল্পপতি মিলে যৌথ ভাবে ১৮০০ বিঘা জমি কিনেছেন ওই পরিবেশ বান্ধব ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির জন্য। সেখানে রোলিং মিল, ফাউন্ড্রি, জুট, প্যাকেজিং, অ্যালায়েড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো মোট তিনশোটি শিল্প গড়ে উঠবে। পাশাপাশি তৈরি হবে কমন ফেসিলিটি সেন্টার, সেখানে দামি আধুনিক যন্ত্রপাতি রাখা হবে। ক্ষুদ্র শিল্পপতিরা অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনমতো সেই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারবেন। এক ক্ষুদ্র শিল্পপতির কথায়: “দামি যন্ত্রপাতি অনেকেরই কেনার ক্ষমতা নেই। তাই এই সেন্টারে সেই সব দামি যন্ত্র রাখা থাকবে কাজের সুবিধার জন্য।” কিন্তু এই পার্কেও তৈরি হয়েছে সমস্যা।
কী সেই সমস্যা?
শিল্পপতিদের কথায়, প্রধান সমস্যা হল জমির মিউটেশন এবং চরিত্র বদল। এ ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দেরি হচ্ছে। সময়মতো তা না পাওয়ায় কারখানা গড়ার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র, ব্যাঙ্ক ঋণ, ট্রেড লাইসেন্স পেতে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট, নিকাশির সমস্যাও রয়েছে। শঙ্করবাবু বলেন, “সমস্যাগুলি সম্পর্কে রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মন্ত্রী মানস ভুঁইয়াকে ও অন্যান্য দফতরে জানানো হয়েছে।” হাওড়ার জেলাশাসক শান্তনু বসু বলেন, “হাওড়া বণিক সভার সঙ্গে কয়েক বার বৈঠক হয়েছে। জগৎবল্লভপুরে যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি হচ্ছে সেটি এবং হাওড়া শহর অঞ্চলের শিল্প-পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রশাসন যথাযথ সহযোগিতা করার চেষ্টা করবে।”
মানস ভুঁইয়া বলেন, “আমি নিজে জগৎবল্লভপুরে গিয়ে ওই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটি দেখেছি। খুব ভাল উদ্যোগ। কাজটি করার জন্য আমাদের দফতর থেকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে। ভূমি-রাজস্ব দফতরকে বলা হয়েছে জমির মিউটেশন ও চরিত্র বদলের বিষয়টিতে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করার জন্য।” মন্ত্রী আরও জানান, মুখমন্ত্রীর কথামতো, সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাওড়া জেলায় বিভিন্ন শিল্পের প্রসারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ করা হচ্ছে। শহরাঞ্চলে শিল্পের পরিকাঠামোর সমস্যার বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে বলে মানসবাবু জানান।

ছবি: রণজিৎ নন্দী ও হিলটন ঘোষ




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.