সওদায় ঠকে গেলে প্রতিকারের ‘ব্রহ্মাস্ত্র’
নাগালেই মজুত, জানেন না শুধু ক্রেতারা
ব্লাউজ বানাতে গিয়ে কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছিলেন দর্জি। তাই ব্লাউজের মালকিনকে ক্ষতিপূরণ দিতে হল। সাড়ে চার হাজার টাকা! অর্থাৎ, পুরো শাড়ির দাম। ব্লাউজ-পিসটা যে শাড়িরই অংশ।
এমন আবার হয় না কি?
হয়। ঠিক জায়গায় ঠিকঠাক অভিযোগ দায়ের করলে হয়। তা হলে ধর্মতলার নামী দর্জির দোকান থেকেও এ ভাবে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়। ফেরত পাওয়া যায় এটিএম থেকে বেহাত হয়ে যাওয়া টাকা। বিমানবন্দর-কর্মীদের হেনস্থায় ‘প্লেন মিস’ করে পরের বিমানের জন্য কাটা টিকিটের পুরো দামও উসুল করা যায়।
কী সেই ‘জাদুদণ্ড?’ যার ছোঁয়ায় এ যুগেও এটা সম্ভব?
এই মুশকিল-আসানের নাম ক্রেতা-সুরক্ষা বা উপভোক্তা দফতর। যেখানে রসিদ, ক্যাশমেমো-সহ প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্র দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ দাখিল করলে বিচারের পরে টাকা ফেরত পেতে পারেন যে কোনও উপভোক্তা। তা সে ভুল চিকিৎসায় পরিজনের মৃত্যু, নার্সিংহোমের অত্যধিক টাকা আদায়, ফ্ল্যাট কিনে ঠকে যাওয়া কিংবা দোকান থেকে খারাপ বা কম পরিমাণে জিনিস পাওয়া যাই হোক না কেন! এমনকী, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারে গ্যাস কম থাকলেও ক্রেতা-সুরক্ষা প্রতিবিধানে প্রস্তুত।
অথচ হাতের কাছে যে এ হেন মুশকিল-আসান মজুত, অধিকাংশ মানুষই তা জানেন না!
রাজ্য ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরের এক কর্তার আক্ষেপ, “এমন একটা দফতর রাজ্যে তো বটেই, জেলায়-জেলায় রয়েছে। কিন্তু তার ক্ষমতা যে এতটা, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা খুবই কম। তাই বহু লোক ঠকেন। সুরাহা চেয়ে তাঁরা বিক্রেতার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে অপমানিতও হন। তবু ক্রেতা-আদালতে যান না।” আমজনতার উদ্দেশে রাজ্যের ক্রেতা-সুরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের আহ্বান, “ওজনে ঠকলে কিংবা জিনিস কিনতে গিয়ে প্রতারকের কবলে পড়লে দফতরে জানান। আমরা প্রতিকার করব। উপভোক্তাকে কোনও খরচ করতে হবে না।”
যে ভাবে, একটা টাকাও খরচ না-করে ধর্মতলার নামী দর্জির দোকান থেকে শাড়ির দাম ফেরত পেয়েছেন সল্টলেকের ওই মহিলা। ব্লাউজ তৈরির সময়ে কাপড় এক জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছিল। দোকানদার তা সেলাই করে দায় এড়াতে চেয়েছিলেন। মহিলা ক্রেতা-সুরক্ষায় যান। সব দেখে-শুনে দফতরের রায়: শুধু ব্লাউজ নয়, সাড়ে চার হাজার টাকা দামের পুরো শাড়ির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারণ, ব্লাউজ-পিসটি ওই শাড়িরই অংশ ছিল।
একই পথে হেঁটে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে বেহাত হওয়া সাড়ে ২৩ হাজার টাকা ফেরত পেয়েছেন চিত্তরঞ্জনের এক যুবক। টাকাটা যে অন্য কেউ তুলেছে, এটিএমের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছিল। তবু ব্যাঙ্ক-কর্তৃপক্ষ গা করেননি। বার বার তাঁদের জানিয়ে ফল পাননি যুবকটি। শেষমেশ উপভোক্তা দফতরের সৌজন্যে তিনি সুদ সমেত পুরো টাকা হাতে পেয়েছেন।
তাঁরই মতো হাতে-নাতে ফল পেয়েছেন মানিকতলার সেই মহিলা। যিনি বার্সেলোনা থেকে মুম্বই হয়ে কলকাতায় ফেরার পথে দেশের বিমানবন্দরে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন। তাঁর দাবি: বিদেশের বিমানবন্দরে চেকিংয়ে সমস্যা না-হলেও মুম্বই বিমানবন্দরে তাঁর ব্যাগে কয়েকটি লিপস্টিক পেয়ে দীর্ঘক্ষণ তল্লাশি চলে। ততক্ষণে কলকাতাগামী বিমান ছেড়ে গিয়েছে। কলকাতা আসতে ৪৬৩৪ টাকা দিয়ে ফের টিকিট কাটতে বাধ্য হন তিনি। বিমানবন্দর-কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর আবেদন ধোপে টেকেনি। পরে উপভোক্তা দফতরে নালিশ করে টিকিটের টাকা ফেরত পেয়েছেন।
সাধারণ মানুষ যাতে মালপত্র কিনে না-ঠকে, তা সুনিশ্চিত করতে ১৯৮৬ সালে উপভোক্তা সুরক্ষা আইন (কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট) চালু হয়। তার ভিত্তিতে তৈরি হয় ক্রেতা-সুরক্ষা দফতর। যারা ক্রেতাদের অভিযোগের নিষ্পত্তি করে দু’টো উপায়ে। একটা হল মধ্যস্থতা। অন্যটি ক্রেতা-সুরক্ষা আদালত।
উপরের তিনটি ঘটনায় অবশ্য ‘মধ্যস্থতা’র মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয়েছিল, বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি। তবে সব ক্ষেত্রে তা হয় না। মধ্যস্থতায় কাজ না-হলে আবেদনকারীকে ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। জেলা আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না-হলে রাজ্য ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতে যাওয়া যায়। সেখানে ‘সুবিচার’ না-পেলে রয়েছে নয়াদিল্লির জাতীয় ক্রেতা-আদালত। কিন্তু অভিযুক্ত বিক্রেতা যদি আদালতের নির্দেশ না মানেন?
রাজ্যের উপভোক্তা সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশনস’-এর সভানেত্রী মালা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কনজিউমার কোর্টের রায় না-মানলেও আদালত অবমাননার শাস্তি হয় না। তাই না-মানার প্রবণতাও রয়েছে।” সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। তবে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক খুব বেশি না-হলে অভিযুক্ত বিক্রেতা মধ্যস্থতাই মেনে নেন বলে জানাচ্ছেন দফতরের আধিকারিকেরা।
ক্রেতা-সুরক্ষার যে এত ক্ষমতা, মানুষ তা সে ভাবে জানে না কেন? সরকারের কি জানানোর কোনও দায়িত্ব নেই?
বস্তুত সরকারি তরফে এ নিয়ে এত দিন তেমন প্রচার চোখে পড়েনি। তবে এখন তা জোরকদমে শুরু হয়েছে বলে মন্ত্রী সাধনবাবুর দাবি। তিনি বলেন, ক্রেতা-অধিকার সম্পর্কে আম-নাগরিককে অবহিত করতে দফতর জেলায় জেলায় শিবির করছে। স্থানীয় বিভিন্ন স্কুল ও ক্লাবকে তাতে সামিল করা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্রেতা-সচেতনতার বিষয়টি যাতে স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সে ব্যাপারে তিনি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “ওজনে কারচুপি ধরতে ক্রেতা-সুরক্ষার অধীনস্থ লিগ্যাল মেট্রোলজি বিভাগ ইতিমধ্যে রাজ্যের সর্বত্র অভিযানে নেমেছে। সব্জি-বাজার থেকে শুরু করে কলকাতার বড় বড় সোনার দোকান অফিসারেরা সর্বত্র ওজন যন্ত্র পরীক্ষা করছেন।” মন্ত্রীর দাবি, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে জরিমানা ও ফি বাবদ দফতরের আয় হয়েছে প্রায় ১৩ কেটি টাকা।
ক্রেতা-সুরক্ষা দফতরের কর্তাব্যক্তিদের আশা, মানুষ সচেতন হলে এই ধরনের কারচুপি নিয়ে আরও অভিযোগ আসবে। তাতে সাধারণ ক্রেতারা যেমন উপকৃত হবেন, তেমন রাজ্যের কোষাগারেও বাড়তি অর্থ আসবে। ‘সচেতনতা’র কিছু ইঙ্গিতও ইদানীং মিলছে। ‘ক্রেতা-সুরক্ষার অধিকার’ সম্পর্কে গত ক’মাস ধরে বেতার-প্রচার শুনে ভবানী ভবনে দফতরের অফিসে এসে খোঁজ নিয়ে গিয়েছেন গড়িয়াহাটের সুতপা বসুমল্লিক, নাগেরবাজারের চন্দন দত্ত, ডানকুনির মনতোষ দত্তেরা। “গ্যাস সিলিন্ডারের ওজন নিয়ে ফি মাসে ডিলারের সঙ্গে ঝগড়া। তিতিবিরক্ত হয়ে গেছি। আগে জানলে কবেই এখানে নালিশ ঠুকে যেতাম!” বলছেন প্রবীণ মনতোষবাবু।
‘জাদুকাঠি’ তৈরিই আছে। শুধু এগিয়ে আসার অপেক্ষা।

ভোক্তা তথ্য

সওদা ৫০ টাকা ছাড়ালেই রসিদ দিতে হবে
জিনিসে বিশ্বাসযোগ্যতার ছাপ দেখানো আবশ্যিক
সব জিনিসে দামের ছাপ থাকতেই হবে
ওজনমাপক যন্ত্রের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক

দোকানে ঢুকে

প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাধ্যতামূলক
প্রেসক্রিপশন ও ওষুধ কেনার রসিদ নষ্ট করবেন না
দাবি কুড়ি লক্ষ টাকা পর্যন্ত: জেলা ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে অভিযোগ
তার বেশি থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত: ভবানী ভবনে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা দফতরে নালিশ।
ক্ষতিপূরণের দাবি কোটি ছাড়ালে যেতে হবে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে
অভিযোগকারী নিজেও সওয়াল করতে পারেন
www.wbconsumers.gov.in দেখুন
ফোন করুন ১৮০০ ৩৪৫ ২৮০৮ নম্বরে

(১ এপ্রিল ২০১১৩১ মার্চ ২০১২)
অভিযোগ ২৭১৪ নিষ্পত্তি ১৩২২



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.