বহু বছর ধরে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা গুলাম মহম্মদ খানের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাঁর স্কুলের দারুণ বুদ্ধিমান বন্ধুটি দেশভাগের রক্তবন্যায় হয়তো আর বেঁচে নেই। ভুলটা ভাঙল ২০০৪ সালে।
সে বছর পৃথিবীর অন্যতম বড় গণতান্ত্রিক দেশ গুলামের মৃদুভাষী বন্ধু মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত করেছে। তার পর মনমোহন এক সাক্ষাৎকারে জানালেন, তাঁর জন্ম পাকিস্তানের এক অখ্যাত গ্রামে। খবরটা পৌঁছেছিল গুলাম মহম্মদের কানেও। শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সে অখ্যাত গ্রামের নাম গাহ্। এই গ্রামেরই রাজা মহম্মদ আলি নামে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আর এক বাল্যবন্ধু বছর চারেক আগে দিল্লি গিয়ে দেখা পেয়েছিলেন মনমোহনের। ক্লাস ফোর অবধি পড়া সহপাঠীকে রাজা উপহার দিয়েছিলেন ১০০ বছরের পুরনো শাল, চকওয়ালি জুতো, গ্রামের মাটি আর জল। মনমোহন তাঁকে দিয়েছিলেন পাগড়ি, নকশা-কাটা শাল। সেই সুবাদে সংবাদ শিরোনামে এসেছিল গাহ্ গ্রামের নাম। দু’বছর আগে মারা যান রাজা। তত দিনে গাহ্কে ‘আদর্শ গ্রাম’ ঘোষণা করে নানা উন্নয়নের পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে। মনমোহন সিংহের সেই বাড়ি অবশ্য গুঁড়িয়ে গিয়েছে বহু দিন আগে। আর ইসলামাবাদের ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে ২৫৫০ বাসিন্দার রুখাশুখা গ্রামটি এখনও পড়ে রয়েছে অনাদরেই। |
গ্রামের ভুট্টা খেতের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সেই দুঃখই করছিলেন গুলাম মহম্মদ। “মনমোহন আমাদের গ্রামের জন্য এত কিছু করবে, কোনও দিন ভাবিনি। কিন্তু আমাদের সরকারই তো কিছু করল না।” গ্রামে এই গুলাম মহম্মদ ছাড়া মনমোহনের আর কোনও বন্ধুই বেঁচে নেই। এই বছরের শেষের দিকে পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসতে পারেন পাকিস্তানে। তত দিনে কি মনমোহনের স্বপ্নের ‘আদর্শ গ্রামে’ অসম্পূর্ণ খাঁ খাঁ বাড়িগুলো তৈরি হয়ে যাবে? জানতে চাইছেন গুলাম।
অথচ মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তৎকালীন পাক শাসক পারভেজ মুশারফের কাছে চিঠি লিখেছিলেন গাহ্-এর উন্নতির জন্য। মুশারফও শান্তি-আলোচনার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওই গ্রামের কথা ভাববেন। পাক পঞ্জাবের সরকার গ্রামে গাড়ি চলার মতো সুন্দর রাস্তা, ছেলেমেয়েদের জন্য হাইস্কুল, হাসপাতাল আর জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল। মনমোহন একটি ভারতীয় সংস্থার সাহায্যে গ্রামের পথে সৌরবাতি লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামের যে ৫১টি বাড়িতে আলো ছিল না, সেখানেও যাতে আলো পৌঁছয়, দেখা হয় সেটাও। কিন্তু সব থেমে গেল ২০০৮-এর পরে। মুশারফকে হটিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পিএমএলএন পঞ্জাবে ক্ষমতায় এল।
তার পর থেকে হাইস্কুল, হাসপাতাল পড়েই রয়েছে। শিক্ষক আর ডাক্তার কেউ নিয়োগ করেনি। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, কাজটা হলে মুশারফের সরকারের প্রশংসা হত, তাই টাকা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে নতুন সরকার কিছুই করেনি।
গাহ্-এর কচিকাঁচা থেকে বুড়োরা এখন আবার আশায় বুক বাঁধছে। বছর শেষে তাদের ‘গ্রামের ছেলে’ পাকিস্তানে এলে যদি কিছু হয়। গুলাম মহম্মদের কথায়, “ওঁকে সবাই দেখতে চায়। ধন্যবাদ দিতে চায়। উনি এলে হয়তো গ্রামের স্কুলে শিক্ষক আসবে, হাসপাতালে ডাক্তার আসবে।” ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বের বাতাবরণ তৈরি করতে পারেন মনমোহনই বিশ্বাস করে গাহ্-এর মানুষ। বাড়িটা ধসে গেলেও মনমোহন সিংহের ছোটবেলার সেই স্কুলটা এখনও দাঁড়িয়ে। যে স্কুলের দেওয়ালে তাঁর মার্কশিটটা আটকানো। ওই মার্কশিট দেখিয়ে গাহ্-এর খুদে পড়ুয়াদের উৎসাহ দেন শিক্ষকরা। ভাবেন, গাহ্-এর গর্ব হয়ে উঠবে অন্য কোনও মনমোহন। |