মুর্শিদাবাদ জেলায় বিভিন্ন সৌধ-শিল্প-ইমারত নিদর্শন গড়ে উঠেছে ষোড়শ শতাব্দী বা পাঠান-মুঘল আমলে। হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ)-এর আমলে তার বিস্তার ঘটে। পরে নবাবি আমলেও (১৭০৪-১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) বিভিন্ন পুরাসম্পদ নির্মিত হয়েছে। ওই পুরাবস্তু নির্মাণে নবাব-বাদশা, রাজা-মহারাজা, জমিদার-ধনবানশ্রেণির নাম উঠে এসেছে। ওই ঐতিহাসিক নির্মাণ শৈলী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যেও পড়ে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় সংস্কারের অভাবে সেগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখে। ফলে এক দিকে ইতিহাসের উপাদান নষ্ট হতে বসেছে, অন্য দিকে সাংস্কৃতিক দিকটিও পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে! |
খেরুর মসজিদ: প্রাক মুঘল যুগের স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। সাগরদিঘি থানা এলাকার ওই মসজিদটির সঙ্গে গৌড়ের মসজিদের গঠন রীতিতে সামঞ্জস্য রয়েছে। ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, “বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুর্শিদাবাদে একমাত্র খেরুর মসজিদে পোড়া মাটির অলঙ্করণ রয়েছে। এর স্থাপত্য রীতিতে লতা-পাতা-গুল্ম এবং গোলাপ ফুলের অলঙ্করণ বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও পশ্চিম দিক লাগোয়া তিনটে মিহ্রাব (ইমাম যেখানে বসে নমাজ পাঠ করেন বা খুদবা বা মঙ্গল প্রার্থনা পাঠ করেন) আছে এবং তার ভাস্কর্যও অসাধারণ। ওই অলঙ্করণে পোড়া মাটির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। যদিও ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পের ফলে ওই মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।” মসজিদের মূল প্রবেশ পথে আরবি ভাষায় এবং তুঘরাম (মধ্য এশিয়ার লিপি) লিপিতে একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়১৪৯৪-৯৫ খ্রিস্টাব্দে মুয়াজ্জম রিফাৎ খাঁ ওই মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি সম্ভবত হুসেন শাহের সেনাপতি ছিলেন। খাজিম আহমেদ বলেন, “খেরুর মসজিদটি স্থাপত্যের ক্ষেত্রে মিশ্র সংস্কৃতির (হিন্দাবী) উদাহরণ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। বাইরের দেওয়ালে আটকোনার পোড়ামাটির অলংকরণ সমৃদ্ধ ৪টি মিনারের মধ্যে তিনটি রয়েছে।” ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সম্প্রতি ওই মসজিদ সংস্কারের ফলে অমূল্য এই পুরাসম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে।”
আতাই: নগরের ২ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। দক্ষিণের একটি মাঠে পাঠান সেনাপতি ওসমানের সঙ্গে মুঘল সেনাপতি মান সিংহের যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে মান সিংহ জয়ী হন। খাজিম আহমেদ বলেন, “এর পরেই মান সিংহের অধীনস্থ কোনও ধর্মপ্রাণ সেনা যুদ্ধজয়ের কারণে সর্বশক্তিমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা বশে ওই মসজিদ নির্মাণ করেন বলে জানা যায়। যদিও প্রামাণ্য তথ্য কিছু নেই।” |
শেরপুর মসজিদ: শেরপুরে বাদশাহী সড়কের পশ্চিম দিকে একটি সুন্দর মসজিদ রয়েছে। সম্রাট শাহজাহানের (১৬২৮-৫৮) সময়ে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মুঘল স্থাপত্য অনুসারে এই মসজিদটি নির্মিত। মসজিদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদটি ১৬ মিটার দীর্ঘ। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে স্থানীয় ধমর্র্প্রাণ ব্যক্তিবর্গ এই মসজিদটি সংস্কার করেন। মসজিদের সামনের দিকে রয়েছে সুবিস্তৃত চাতাল ও স্তম্ভ। সঙ্গে দু-পাশে দুটি সুদৃশ্য কক্ষ। সংস্কারের সময়ে আকার-বহরেও বৃদ্ধি ঘটে। মসজিদের সামনে ইট দিয়ে বাঁধানো চত্বর রয়েছে। পুকুরও রয়েছে।
কাটরা মসজিদ: মুর্শিদাবাদের প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ (১৭০৪-১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ) মক্কার মসজিদের অনুকরণে ১৭২৩-২৪ খ্রিস্টাব্দে এক বছরের মধ্যেই ওই মসজিদ নির্মাণ করেন। মুরাদ ফরাস নামে তাঁর এক বিশ্বস্ত কর্মী ওই মসজিদ নির্মাণের কাজ দেখভাল করেন। কাটরা মসজিদের মূল প্রবেশ পথের সিঁড়ির নিচেই মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি স্থল। মালদহের আদিনা মসজিদ ছাড়া এত বড় মসজিদ রাজ্যে আর নেই। পরিকল্পনা করে শাসনকেন্দ্র হিসেবে এই এলাকা গড়ে তোলা হয়। ফলে সমৃদ্ধ শহর গড়ে ওঠে। এই মসজিদের ভেতরে যে মাদ্রাসা ছিল, সেখানে বহু ছাত্র পড়াশোনা করতেন। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঐতিহাসিক ওই সৌধটি। ৭০০ কারি বাস করতেন। তাঁরা কোরান পাঠ করতেন।
ফৌতি মসজিদ: হাজারদুয়ারি থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে এবং কাটরা মসজিদের পশ্চিম দিকে লালগোলা-শিয়ালদহ রেল পথের পাশেই শহর মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট মসজিদ ফৌতি মসজিদ। মুর্শিদকুলি খাঁর দৌহিত্র নবাব সরফরাজ খাঁ (১৭৩৯-৪০ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হলে ওই মসজিদ অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। চারি দিক খোলা একটি প্রশস্ত জমির উপরে অত্যন্ত অবহেলিত এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মসজিদ লাগোয়া জায়গাও বেদখল হয়ে গিয়েছে। সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় এখন ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই অসাধারণ মসজিদটি। মসজিদের দেওয়ালে ইন্দো-সারাসেনিক স্থাপত্যশৈলীর কারুকাজ রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণের। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে বাঙালি শিল্পীকৃত পঙ্কের সজ্জা বিশেষ ভাবে অলঙ্কৃত রয়েছে। |
মতিঝিল মসজিদ: লালবাগ কোর্ট স্টেশন থেকে এক কিমি দক্ষিণে লালবাগ-বহরমপুর রাজ্য সড়কের ধারেই মতিঝিল মসজিদ। আলিবর্দি খাঁয়ের জ্যেষ্ঠ জামাতা ঘষেটি (মেহেরুন্নেষা) বেগমের স্বামী নবাব নওয়াজেস আহমদ খাঁ এই অতি সুদৃশ্য ঝিল এবং তার তীরে ‘শাহি দালান’ নামে এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এখন তা অবলুপ্ত। নওয়াজেস খাঁ (১৭৫০-৫১ খ্রিষ্টাব্দ) ওই মতিঝিল মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদে নওয়াজেস-এর স্বহস্ত লিখিত আল্-কোরানের পুঁথি সযত্নে রক্ষিত আছে। মসজিদ প্রাঙ্গণে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার কনিষ্ঠ ভ্রাতা এক্রাম-উদ-দৌল্লার সমাধিও রয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সংস্কারের দায়িত্ব নিয়েছে।
চক মসজিদ: মুর্শিদকুলি খাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মুন্নি বেগম ১৭৬৭ সালে দরবেশ বিনকার ওয়াজেদ আলির তত্ত্বাবধানে চক বাজার এলাকায় চেহেল সেতুনের দক্ষিণে তৈরি করেন ১২৫ ফুটের সুবিশাল মসজিদ। ওই মসজিদের সাতটি গম্বুজ আছে।
|