ইশাকজাদে...লে হালুয়া লে...আওয়ারা...।
ছাপানো স্লিপে ছবির নাম। সিনেমা হল-এর নাম। সঙ্গে আর একটি কাগজে ‘নোট’ করা আছে, হলের মোট আসন সংখ্যা। কত টাকার টিকিটের জন্য ক’টি আসন এবং দৈনিক বিক্রির হিসেব।
সপ্তাহভর সিনেমা হলে ঘুরে ঘুরে হিসেব মিলিয়ে নেওয়া। হলের মধ্যে বাড়তি লোক ঢোকানো হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখা। মাথার উপরে আদ্যিকালের পাখা! বাঘা টর্চ হাতে হল-এর আনাচেকানাচে উঁকি আর কাউন্টার-ঘরে পাখির চোখ।
সিনেমা হল চত্বরে লোকমুখে ওঁদের পরিচয়, ‘ফিল্মবাবু’। চলচ্চিত্র পরিবেশকদের খাতায় আর ইউনিয়নের লগবুকে এঁরা ‘ফিল্ম রিপ্রেজেন্টেটিভ’।
চলচ্চিত্র ব্যবসার লক্ষ লক্ষ টাকার হিসেব রাখেন এই ফিল্মবাবুরা। অথচ মাস গেলে তাঁদের নিজেদের রোজগার আড়াই হাজার টাকারও কম। হিন্দি ছবির ব্যবসা এখন প্রায়শ ১০০ কোটি ছাড়াচ্ছে। বাংলা ছবির বাজেটও সাত-আট কোটিতে পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ ২০১২ সালেও এই ফিল্মবাবুদের মজুরি দৈনিক ১১৫ টাকা। হপ্তায় ৮০০ টাকা। মাসে তিন সপ্তাহের বেশি ‘ডিউটি’ পড়ে না। পিএফ-গ্র্যাচুইটি নেই, বিমা পরিষেবা নেই। ইএসআই প্রকল্পের সুবিধাও নেই। কারণ খাতায়কলমে এঁরা সবাই আংশিক সময়ের কর্মী।
এক সময় পরিবেশক সংস্থাগুলো নিজেরা মাইনে করা লোক রাখত। পাশাপাশি ‘ক্যাজুয়াল স্টাফ’রাও থাকতেন। বিহার-ওড়িশা-অসম-মণিপুর-সিকিম, এমনকী নেপাল-ভুটানের হল-এও পরিদর্শনে যেতে হত। ছবির প্রিন্ট হল-এ পৌঁছে দেওয়া বা হল থেকে টাকা সংগ্রহ করে এনে পরিবেশককে দেওয়াও তাঁদের কাজ ছিল। বাঁধা চাকরির সেই রিপ্রেজেন্টেটিভরা এখন আর নেই বললেই চলে। রাজ্যে টিমটিম করছেন ৩১০ জন ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ’। পরিদর্শন এলাকাও ছোট হয়ে এসেছে। রাজ্যের বাইরে যেতে হয় না। উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গে অঞ্চলভিত্তিক কাজের সীমানা তৈরি হয়েছে। যিনি যে অঞ্চলের বাসিন্দা, তিনি সেই অঞ্চলের হল-এর দায়িত্বই সামলান।
ধনেখালির বাসুদেব মুখোপাধ্যায় ১৯৭০ সাল থেকে এই পেশায়। তখন এ রাজ্যে প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শকদের সংস্থা ছিল, বেঙ্গল মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন। সেখানে রিপ্রেজেন্টেটিভদের কোনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ১৯৭৫ সালে ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন (ইম্পা) তৈরি হল। তখনই প্রথম বার ফিল্ম রিপ্রেজেন্টেটিভরাও ইম্পা-র অধীনে পরিবেশক ও কর্মী ইউনিয়নের আওতায় এলেন। বাসুদেব ছিলেন সেই ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। বাসুদেব বারবার করে স্মরণ করেন, ইউনিয়ন গঠনের পিছনে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা। বলেন, ‘‘উনি ছিলেন বলেই নির্বিচার ছাঁটাইয়ের হাত থেকে বাঁচলাম।”
১৯৭৬ থেকে ২০১২, চলচ্চিত্র ব্যবসার খোলনলচে বদলে গিয়েছে। প্রিন্টের ছবি আর সিঙ্গল স্ক্রিন হল, দুইই ক্রমশ কমছে। (রাজ্যে এক সময় হাজারের উপর সিনেমা হল ছিল, এখন তার সংখ্যা তিনশোর কিছু বেশি) অতএব ফিল্ম রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে আসছে। মোবাইল ফোন, ই-মেল সর্বত্র পৌঁছে গিয়েছে। ফলে দৈনিক হিসেব মেলানোর কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। হলমালিক-রিপ্রেজেন্টেটিভ ‘আঁতাঁতে’ হিসেবে গরমিলের সুযোগও থাকছে না বলে পরিবেশকদের দাবি। মাল্টিপ্লেক্সগুলোয় সাপ্তাহিক হিসেব মেলানোর দরকারই হয় না। তারা পরিবেশকদের সঙ্গে
নির্দিষ্ট অঙ্কের আগাম চুক্তি করে থাকে। প্রিন্ট থেকে ডিজিটাল প্রোজেকশনে বদলটাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে বলে জানালেন প্রযোজক-পরিবেশক হিমাংশু ধানুকা। ‘‘আগে ছবির প্রিন্ট হল-এই রাখা থাকত। পাইরেসি আটকানোর জন্য নজরদারির প্রয়োজন ছিল। ডিজিটাল প্রোজেকশনে সেই প্রয়োজনটা নেই।”
ইম্পা-র পরিবেশনা বিভাগের চেয়ারম্যান সুভাষ দত্ত বাংলা ছবির বাজারে দুর্দশার কথাও একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিলেন। আগে এক-একটা ছবি অনেক সপ্তাহ ধরে চলত। পরিবেশক এবং রিপ্রেজেন্টেটিভ উভয়েই তার সুফল পেতেন। সে দিন এখন আর নেই। রিপ্রেজেন্টেটিভ পাঠানোটাই পরিবেশকদের কাছে বাড়তি খরচ! “হয়তো ২০টা হলে ছবি পাঠিয়ে সপ্তাহে তিন হাজার টাকার ব্যবসা হয়েছে। রিপ্রেজেন্টেটিভদের ‘বিল’ ১৬০০ টাকা! পরিবেশকদের কাছে এটা বোঝা হয়ে যাচ্ছে!”
কিন্তু যে ৩১০ জন ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ’ এখনও কাজ করে চলেছেন, তাঁদের ভবিষ্যতের কী হবে? টালিগঞ্জের সুনীল বসু, ডায়মন্ড হারবারের সুকুমার দাশ, পাঁশকুড়ার এম এন খানদের বক্তব্য, “মাসে ২৪০০ টাকায় পেট চালানোই দায়, ভবিষ্যতের চিন্তা দূর অস্ত্!” ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের তরফে প্রযোজক-পরিবেশক মহেন্দ্র সোনি বললেন, “যাঁরা এখনও রয়ে গিয়েছেন, মানবিক কারণেই তাঁদের কাজ দিয়ে চলেছি আমরা। ওঁদের জন্য এককালীন কিছু টাকার ব্যবস্থা করার ভাবনা রয়েছে।” হিমাংশুর বক্তব্য, “রিপ্রেজেন্টেটিভদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য ইম্পা যদি প্রস্তাব দেয়, আমরা অবশ্যই সেটা মেনে নেব। কিন্তু প্রস্তাবটা ইম্পা-র তরফ থেকে আসতে হবে।” সুভাষবাবু বলছেন, “পরিবেশকরা যদি রাজি থাকেন, তাহলে বিষয়টা ইম্পা অবশ্যই বিবেচনা করবে।” ইম্পা-র প্রেসিডেন্ট তথা প্রযোজক সুরিন্দর সিংহের বক্তব্য, “রিপ্রেজেন্টেটিভদের বেতন বাড়ানোর বিষয়টি ইম্পা-র আলোচ্যসূচিতে রয়েছে।”
সত্তর দশকে এই ‘ফিল্ম রিপ্রেজেন্টেটিভ’দের পাশে দাঁড়ানো সুব্রত মুখোপাধ্যায় বর্তমানে রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী। বাসুদেববাবুদের দুর্দশার কথা জানাতে তিনি বললেন, “ওঁদের দাবি নিয়ে সরব হওয়া দরকার। ওঁরা চিঠি দিলে আমি তা মুখ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে পারি।”
|
|
শহরের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ঘুরে নিজের অভিনীত ছবি ‘মুক্তধারার’ প্রচার ও
স্বাধীনতা দিবস পালন করলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র |
|