অ্যাথলিটদের মিলনমেলা শেষে আন্তর্জাতিক সাঁতার সংস্থা জলের রাজপুত্র মাইকেল ফেল্পসের হাতে যে ট্রফিটা তুলে দিয়েছে, তাতে লেখা, ‘গ্রেটেস্ট অলিম্পিক অ্যাথলিট অব অল টাইম’। কিন্তু কোথাও একটা প্রশ্নচিহ্ন ওই ট্রফিকে ঘিরে থাকছে। বিশেষজ্ঞদের গরিষ্ঠ অংশ তো বটেই, সাধারণ মানুষের ভোটেও অলিম্পিক শেষে বিশ্বসেরা অ্যাথলিট হওয়ার দৌড়ে শীর্ষবাছাই বিশ্বের দ্রুততম মানুষ চলমান বিদ্যুৎ উসেইন বোল্ট।
বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্রীড়ামঞ্চে অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স করে যাঁরা কিংবদন্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবিদার হতে পারেন, এ বারের অলিম্পিকে তেমন নাম হাতে গোণা চারটি। সুইমিং পুলে এ বার চার সোনা ও দুই রুপো জিতে নিজের অলিম্পিক পদক সংখ্যা ১৮টি সোনা সহ মোট ২২-এ নিয়ে চলে গিয়েছেন মাইকেল ফেল্পস। মোট পদকসংখ্যাই যদি বিচারের মাপকাঠি হয়, ফেল্পস নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা। আবার বোল্টের কীর্তি বিচারে জনমানসে আগে আসছে বঙ্কিম সুলভ আবেগ, “আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!” পরপর দুটো অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে সোনা জিতে নেওয়া বোল্টের কীর্তির পাশে কোনও কিছুকেই রাখতে পারছেন না অনেক বিশেষজ্ঞই। তাঁর এক একটা ‘স্ট্রাইড’-এর সঙ্গে মন ভাল করে দেওয়া কবিতার ছন্দের তুলনাও উঠে আসছে বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং সাইটে চোখ রাখলে। |
এ ছাড়াও থাকছেন আরও দুই কীর্তি, যা চোখ টেনেছে এই অলিম্পিকে, আর পাঁচটা ইভেন্টের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে। এক, ৮০০ মিটারে কেনিয়ার ডেভিড রুডিশার সোনা জয় আর দুই, মেয়েদের ৪x১০০ মিটার দৌড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের স্বপ্নের দৌড়। রুডিশার বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জয় নিয়ে লন্ডন অলিম্পিকের আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান ও মিড ডিসট্যান্সে সোনা জয়ী প্রাক্তন সেবাস্তিয়ান কো উচ্ছ্বসিত, “বোল্ট ভাল, কিন্তু সেই রাতে রুডিশা ছিল অসাধারণ। মনে হচ্ছিল অন্য গ্রহের কেউ।” আবার মার্কিন মেয়েদের রিলেতে উড়ে যাওয়া কাউকে কাউকে মনে করিয়ে দিয়েছে ১৯৮৫-তে পূর্ব জার্মানির মেয়েদের ওই ইভেন্টে করা বিশ্বরেকর্ডকে। সরকারি ডোপিং প্রোগ্রামের মদতে করা ওই রেকর্ড এ বারে অলিম্পিকে ভেঙে চুরমার।
কিন্তু রুডিশা বা মেয়েদের রিলে নয়, জনপ্রিয়তার বিচারে এ বারে অলিম্পিকে শীর্ষবাছাই বোল্ট। ২০০ মিটারে তাঁর স্বপ্নের দৌড়ের সময়ে টুইটারে মিনিটে পোস্টের সংখ্যা ৮০ হাজার। আর ১০০ মিটার দৌড়ের সময় সংখ্যাটা ছিল মিনিটে ৭৪ হাজার। এ দেশের খেলাধুলোর দুনিয়ায় উঁকি মারলেও সীমাহীন মুগ্ধতা। “ফেল্পস আমার দেখা সেরা ক্রীড়াবিদ। সর্বকালের সেরা। কিন্তু এই অলিম্পিকে আগে আমি উসেইন বোল্টকেই রাখব। আমি ১০০ ও ২০০, ওর দুটো দৌড়ই দেখেছি। চোট সারিয়ে উঠে একটা লোক স্প্রিন্টকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা বোল্ট দেখিয়েছে,” বলছেন ভাইচুং ভুটিয়া। বাঙালির খেলাধূলোর ক্রিকেটীয় মহানায়ক অবশ্য কাউকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখায় বিশ্বাসী নন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, “নাহ, তুলনায় না গিয়ে আমি বরং খেলাধুলোর মঞ্চে এই দুটো লোকের কীর্তি উপভোগ করব। দু’জনেই জিনিয়াস আর তার চেয়েও বড় কথা, এই দুই জিনিয়াসের কীর্তির বিচার করার অধিকার আমার আছে বলে মনে হয় না।” ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ে উঠে জাতীয় দলে ফিরে ইতিহাস সৃষ্টিকারী যুবরাজ সিংহের ভোট সরাসরি বোল্টের দিকে। নেটওয়ার্কিং সাইটে বলে ফেলেছেন, “উসেইন বোল্ট ইউ বিউটি। কী রেস হল, কী জয়।” |
ফেল্পসের ২২টি সোনার পদক মাথায় রেখেও চুনী গোস্বামী বেছে নিচ্ছেন বিশ্বের দ্রুততম মানুষকে। ব্যাখ্যাও স্বচ্ছ। “সাঁতার বা ফেল্পসকে কোনও ভাবে ছোট করছি না। কিন্তু চার বছর পরে স্প্রিন্টে ১০০ বা ২০০ মিটারে সোনা জেতাটা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার। একজন সাঁতারু তার পিক সময়ে ফিটনেস রেখে তিনটে অলিম্পিক পেতে পারে, অনেক ইভেন্ট পেতে পারে। কিন্তু ১০০ বা ২০০ মিটারের স্প্রিন্টাররা সেটা পায় না। সেরা সময়টা বড়জোর কুড়ি থেকে ছাব্বিশ। এটা মাথায় রাখছি বলেই এ বারের অলিম্পিকে তো বটেই, সর্বকালের সেরা হিসেবেও আগে বোল্টকে রাখব,” বলছেন চুনী। ফরাসি ক্রীড়াদৈনিক ‘লেকিপ’-এ অনেকটা একইরকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন এক ক্রীড়াবিজ্ঞানী, “সাঁতারে আপনি পনেরো বা ষোল বছরে অলিম্পিকে নামা অনেককে পাবেন। কিন্তু স্প্রিন্টে নয়। এখানে দেখা যাবে ন্যূনতম বয়সটা ১৯ থেকে ২১। কারণ এই সময়টাতেই পুরুষের পেশি ও শক্তি পরিণতি পায়। দুটো অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সোনা জয় স্রেফ শক্তির বিচারে প্রায় অতিমানবিক একটা কীর্তি।”
অলিম্পিক কমিটি সর্বকালের সেরার ট্রফি ফেল্পসকে দিতে পারে, কিন্তু অমীমাংসিত বিতর্কে চিরকালই থেকে যাওয়ার মতো কীর্তি বোল্টেরও থাকছে। |