ব্যঙ্গচিত্র-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং তাঁর বৃদ্ধ প্রতিবেশী সুব্রত সেনগুপ্তকে গ্রেফতার করার ঘটনায় রাজ্য সরকারকে জরিমানা দিতে বলল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের সুপারিশ, দু’জনকে ৫০ হাজার টাকা করে মোট ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। যে দুই পুলিশ অফিসার ওই গ্রেফতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করারও সুপারিশ করেছে কমিশন।
চার মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় এবং দীনেশ ত্রিবেদীকে নিয়ে একটি ‘ব্যঙ্গচিত্র’ ই-মেলে ফরওয়ার্ড করে গ্রেফতার হয়েছিলেন রসায়নের অধ্যাপক অম্বিকেশবাবু ও অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার সুব্রতবাবু। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন অমিত সর্দার নামের এক যুবক। তিনি অভিযোগপত্রে নিজেকে তৃণমূলের চকবেড়িয়া ছিটনয়াবাদ আঞ্চলিক কমিটির সদস্য বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। অম্বিকেশবাবুর অভিযোগ, থানায় আনার আগে তাঁদের মারধরও করেন অমিত ও তাঁর সঙ্গীরা। গ্রেফতারের পরে সারা রাত পূর্ব যাদবপুর থানার লকআপে কাটিয়ে পর দিন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান তাঁরা। গত ১৯ জুলাই এই মামলার চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। |
এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ‘স্বতঃপ্রণোদিত তদন্ত’ শুরু করেছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তদন্ত চলাকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দাকেও ডেকে পাঠিয়েছিল কমিশন। সোমবার ওই তদন্তের রিপোর্ট রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষের পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মহাকরণে জানান, “রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। খতিয়ে দেখে যা বলার বলব।” তৃণমূল তথা রাজ্য সরকারের তরফে ঘটনার সময় বলা হয়েছিল, প্রথমত, এটি ব্যঙ্গচিত্র নয়। দ্বিতীয়ত, এখানে খুনের ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে।
যদিও কমিশন জানিয়েছে, বিশিষ্ট ব্যক্তি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র আঁকায় দোষের কিছু নেই। ১৮৪০ সাল থেকে সংবাদপত্র বা বিভিন্ন ধরনের পত্রিকায় ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়ে আসছে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিজেদের ‘ভুল’ স্বীকার করে নেওয়া সত্ত্বেও অম্বিকেশবাবুদের কেন গ্রেফতার করা হল, তার সদুত্তর পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
কমিশনের যুগ্ম সচিব সুজয়কুমার হালদার এ দিন জানান, অম্বিকেশবাবুদের গ্রেফতারের ব্যাপারে পুলিশের ভূমিকায় কমিশন সন্তুষ্ট নয়। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। গ্রেফতারের আগে তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ এফআইআর দায়েরও করেননি। গ্রেফতারের পরে অমিত সর্দার এফআইআর দায়ের করেন। পুলিশের এই ভূমিকায় মানবাধিকার কমিশন অসন্তুষ্ট বলেও রিপোর্টে বলা হয়েছে।
রিপোর্টে পূর্ব যাদবপুর থানার দুই পুলিশ অফিসার সঞ্জয় বিশ্বাস এবং মিলন দাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত করার সুপারিশ করেছে কমিশন। ছ’সপ্তাহের মধ্যে রাজ্য সরকারকে কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারকে এই সুপারিশ মানতেই হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। রাজ্য সুপারিশ না মানলে কেন্দ্রীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন করতে পারে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তাদের সুপারিশও রাজ্য না মানলে তখন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করতে পারে।
যদিও এ দিন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “রাজ্য সরকারের উচিত মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ মেনে নেওয়া।”
কমিশনের সুপারিশের কথা শুনে দৃশ্যতই খুশি অম্বিকেশবাবু। তিনি বলেন, “আমাদের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা মামলা করা হয়েছিল, কমিশনের তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে। মারধর, হেনস্থার কথাও প্রকাশ্যে এসেছে। এটা গণতন্ত্রের জয়।” যে দুই পুলিশ অফিসার তাঁদের গ্রেফতার করেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে অম্বিকেশবাবু বলেন, “ঘটনার দিন ওই দু’জনের ব্যবহারে মনে হয়েছিল, কারও চাপে পড়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁরা ওই কাজ করছেন। কমিশনের কাছে অনুরোধ, ওই অফিসারেরা কার নির্দেশে ওই কাজ করেছিলেন, তা-ও তদন্ত করে দেখা হোক।”
কমিশনের রিপোর্টে অম্বিকেশবাবুর মতোই খুশি নিউ গড়িয়া কো-অপারেটিভ-এর সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, “কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হল, রাজ্য সরকার এই ঘটনায় নিরপেক্ষ আচরণ করেনি।”
|
চিত্র-তরঙ্গ |
কমিশন কী বলল |
• অম্বিকেশবাবু ও সুব্রতবাবুকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ
• রাজ্যকে টাকা দিতে হবে ৬ সপ্তাহের মধ্যে
• পূর্ব যাদবপুর থানার দুই অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত হোক
• বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র করা আদৌ দোষের নয়
• রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় |
কী ঘটেছিল |
• ১৮ মার্চ রেলমন্ত্রীর পদে দীনেশ ত্রিবেদীর ইস্তফা। পরে তা নিয়ে ফেসবুকে ব্যঙ্গচিত্রের ঢল। মুখ্যমন্ত্রী, দীনেশবাবু ও মুকুল রায়কে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র অম্বিকেশবাবুও ফরওয়ার্ড করেছিলেন।
• ১২এপ্রিল রাত ৯টা অম্বিকেশবাবু ও সুব্রত সেনগুপ্তকে মারধর করে কিছু তৃণমূল সমর্থক। জবরদস্তি মুচলেকা। রাত ১০টা দু’জনকে পূর্ব যাদবপুর থানায় আনা হয়। গ্রেফতার করে রাতভর লক-আপে। অভিযোগ: মুখ্যমন্ত্রীর মানহানি, সম্মান-শালীনতায় আঘাত, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে অশ্লীল ছবি পাঠানো।
• ১৩ এপ্রিল নিম্ন আদালতে দু’জনের জামিন।
• ১৯ জুন গ্রেফতারির ব্যাখ্যা চেয়ে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের তলব পুলিশ কমিশনারকে। |
|