হাসপাতালের বিরুদ্ধে অব্যবস্থার নানান অভিযোগ তুলে ‘পালাই পালাই’ করছিলেনই। শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল ছেড়ে বাড়িই ফিরে গেলেন বালুরঘাটের ‘বিশাল কন্যা’ সিদ্দিকা পরভিন।
আস্থা রাখতে পারলেন না রাজ্যের একমাত্র ‘সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল এসএসকেএমের উপরে। রাজ্য সরকারের দেওয়া বিনামূল্যে চিকিৎসার প্রতিশ্রুতির উপরেও ভরসা করতে পারলেন না। রবিরার সকালে পিজি-
|
সিদ্দিকা পরভিন |
কর্তৃপক্ষের কাছে ‘রিস্ক বন্ড’ জমা দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্সে মেয়েকে নিয়ে বালুরঘাট রওনা হন সিদ্দিকার বাবা আফতাবউদ্দিন আহমেদ। পারিবারিক সূত্রের খবর, পথে বহরমপুরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন সিদ্দিকা। বমি করেন কয়েক বার। দক্ষিণ দিনাজপুরে বংশীহারির শ্রীরামপুর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছতে রাত হয়ে যায়।
কেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ ও সরকারের উপরে ভরসা হারালেন সিদ্দিকা ও আফতাবউদ্দিন?
বাড়ির পথ ধরার আগে সিদ্দিকার বাবা বললেন, “এখানে থাকলে মেয়েটা আমার বাঁচবে না। আমরাও অসুস্থ হয়ে পড়ব। ভাল চিকিৎসার আশা আর করছি না। মেয়েটার ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হোক।”
পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমারের জন্য বৃদ্ধি-হরমোনের অত্যধিক নিঃসরণে ২৫ বছরে সিদ্দিকার উচ্চতা দাঁড়িয়েছে আট ফুট। তাই তাঁর বাড়তি খাবার লাগে। শোয়ার জন্য লাগে বেশি জায়গা। আফতাবউদ্দিনের অভিযোগ, হাসপাতালে মেয়ের খাওয়া-শোয়ার অসুবিধা তো হচ্ছিলই। তবে সেটা তাঁরা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্য যখন তাঁদের ৫৫ হাজার টাকার ইঞ্জেকশন কিনে দিতে বলা হল, তাঁরা বুঝে গেলেন, নিখরচায় চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি আসলে ‘মিথ্যা’। তাঁর কথায়, “মেয়েকে কলকাতায় আনার সময় অনেক ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমকে ডেকে, ছবি তুলে আনা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু তার পরে আমরা এখানে কেমন আছি, মেয়েটার চিকিৎসা কেমন হচ্ছে, কেউ তার খোঁজ নেয়নি। আমরা আতান্তরে পড়ে গিয়েছি।”
এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “চিকিৎসার জন্য একটা টাকাও চাওয়া হয়নি। কেনই বা চাওয়া হবে? মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে মেয়েটিকে কলকাতায় এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওর দায়িত্ব তো সরকার নিয়েছে।”
তা হলে সিদ্দিকা চলে গেলেন কেন?
মন্ত্রীর যুক্তি, “টিউমার অস্ত্রোপচার করা হবে জেনে ওঁরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শনিবার হাসপাতালে এক ঘণ্টা ধরে ওঁদের কাউন্সেলিং হয়। কিন্তু ভয় কাটানো যায়নি। চলে যাওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধিরা বালুরঘাটে গিয়ে কথা বলবেন।”
‘ভয় পেয়ে’ চলে যাওয়ার যুক্তি এ দিন শোনা গিয়েছে পিজি-কর্তৃপক্ষের মুখেও। এসএসকেএম তথা ইনস্টিটিউট অফ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র বলেন, “বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজিতে সিদ্দিকার পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঁর বাবার আশঙ্কা, অত বড় অস্ত্রোপচার হলে মেয়ে বাঁচবে না। আমরা অনেক বোঝানো সত্ত্বেও কাজ হল না।”
সত্যিই কি অস্ত্রোপচার নিয়ে আফতাবউদ্দিনদের মনে কোনও সংশয় তৈরি হয়েছে?
সিদ্দিকার বাবার জবাব, “এমনিতেই কেউ মেয়েটার খোঁজ নেন না। অত বড় অপারেশনের পরে যদি হেলাফেলা করে ফেলে রাখা হয়, মেয়েটা তো বাঁচবেই না। তা ছাড়া এখনই ইঞ্জেকশনের জন্য টাকা চাইছে। অপারেশনের সময় আরও টাকা লাগবে। কোথা থেকে দেব?”
সিদ্দিকার ভাই, বংশীহারী ব্লক ছাত্র পরিষদের সভাপতি মাসুম আক্রম অভিযোগ করেন, “এসএসকেএমে প্রায় বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখায় দিদির টিউমার বড় হয়ে গিয়েছে।” যিনি সিদ্দিকাকে বালুরঘাট থেকে পিজি-তে পাঠাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেই তৃণমূল বিধায়ক তথা কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
সিদ্দিকা এ ভাবে চলে যাওয়ায় চিকিৎসকেরা হতাশ। সিদ্দিকার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের এক সদস্য বলেন, “এই ধরনের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। সেটা ওঁদের বোঝানো যায়নি। আসলে ওঁকে আনার সময় এমন অনেক আশা দেওয়া হয়েছিল, যার খুব একটা বাস্তব ভিত্তি নেই। সেই কারণেই একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। এই ভুল বোঝাবুঝি কাটানোর দায় সরকারেরই নেওয়া উচিত।
বেলা ১১টা নাগাদ সিদ্দিকাকে নিয়ে পিজি থেকে রওনা হন তাঁর বাবা। কয়েক জন পড়শিও সিদ্দিকাকে নিতে এসেছিলেন। অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থাও পরিবারের তরফেই করা হয়। পিজি-কর্তৃপক্ষ জানান, রিস্ক বন্ডে সই করে রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অর্থ, পরিবারের লোকজন নিজেদের ঝুঁকিতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। সে-ক্ষেত্রে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের কোনও ভূমিকা থাকছে না। তাই অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করার দায় নেই হাসপাতালের। |