ভবিতব্যের মোড় ঘুরিয়ে জীবনের জয়গান
জরায়ু-ক্যানসারকে হারিয়ে সুস্থ সন্তানের জননী টিনা
চারপাশে আর কোনও অন্ধকার টের পাচ্ছেন না টিনামুনি। এখন শুধুই আলো। সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে আঁকড়ে সেই আলোর গল্প সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান বছর পঁচিশের এই তরুণী।
ক্যানসার মানেই সব আশা-আকাঙ্খার মৃত্যু, জীবনে দাঁড়ি পড়ে যাওয়া প্রচলিত এই ধারণাটাকে টিনামুনি এক ঝটকায় বদলে দিতে পেরেছেন। আর এই লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গী, কলকাতারই তিন চিকিৎসক। তাঁদের তত্ত্বাবধানে
টিনামুনি
জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত এই তরুণী বৃহস্পতিবার বিকেলে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন।
ঘটনার সূত্রপাত বছর চারেক আগে। হুগলির ডানকুনির মেয়ে টিনামুনির সঙ্গে বিয়ে হয় হাওড়ার মাকড়দহের বাসিন্দা শেখ গোরার। বিয়ের মাস চারেকের মাথায় অন্তঃসত্ত্বা হন টিনা। কিন্তু তিন মাস গড়াতে না গড়াতেই ঘটে যায় গর্ভপাত। দিন কয়েক হাসপাতালে ভর্তি থাকার পরে বাড়ি ফিরেও রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিল না। বছর খানেক পরে ধরা পড়ে, টিনার জরায়ুতে ক্যানসার হয়েছে।
তার পর? প্রথমে কেমোথেরাপি, তার পরে অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দেওয়া এটাই স্বীকৃত প্রক্রিয়া। টিনার ক্ষেত্রেও তেমনটাই স্থির হয়েছিল। চারটি কেমোথেরাপির পরে চিকিৎসকেরা যখন অস্ত্রোপচারের দিনক্ষণ স্থির করছেন, তখনই বেঁকে বসলেন টিনা। কেন? টিনার কথায়, “জরায়ু বাদ যাওয়া মানে আমার আর কোনও দিন মা হওয়া হবে না। অথচ আমরা দু’জনেই একটা সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল, জরায়ু বাদ গেলে সেই জীবনে কী লাভ?”
টিনার জেদেই শুরু হল বিকল্প পথের ভাবনা। টিনার চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, “টিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, সন্তান না থাকলে সেটা ওদের পরিবারে একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাই আমরাও ঝুঁকিটা নিয়ে নিলাম।” টিনার পাশে দাঁড়ালেন তাঁর বাবা আবদুল্লা গাজি-ও। এ দিন দুপুরে পার্ক স্ট্রিটের নার্সিংহোমে তিনি বলছিলেন, “ভেবেছিলাম, ক্যানসার ধরা পড়ার পরেও মেয়ে যখন লড়তে চাইছে, তখন আমি কেন সঙ্গে থাকব না?”
আদরের ধন। টিনামুনির সদ্যোজাত পুত্রসন্তান।
লড়াইয়ের প্রথম ধাপ, অবশ্যই কেমোথেরাপি। কেমোথেরাপির পরে দেড় বছর পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা চালানো হল। তার পরে সন্তানধারণের অনুমতি পেলেন টিনা। গর্ভবতী হওয়ার পরে নিয়মিত তাঁকে নজরে রাখা হয়েছে, পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছে। সেই নজরদারিতেই ৩৭ সপ্তাহের মাথায় ধরা পড়ল, টিনার টিউমার আবার বাড়ছে! তখনই অস্ত্রোপচার করে টিনার সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলেন চিকিৎসকেরা। তারই জেরে বৃহস্পতিবার চিকিৎসক চিন্ময় বসু এবং পিনাকীরঞ্জন গুপ্তের তত্ত্বাবধানে ৩ কিলো ওজনের ফুটফুটে ছেলেটির জন্ম দিলেন টিনা। পিনাকীবাবু বলেন, “যে মুহূর্তে সমস্যা টের পেয়েছি, সন্তানকে বার করে নেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে মা ও সন্তান দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।”
টিনার যে রোগ হয়েছিল, ডাক্তারি পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘কোরিওকার্সিনোমা’। সেখানে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় প্ল্যাসেন্টা থেকে ক্যানসার ছড়ায়। গর্ভপাতের ভয় তো থাকেই, পাশাপাশি অন্যান্য অঙ্গে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ারও ঝুঁকি থাকে। এ রোগের মূল উপসর্গই হল, অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ। এখন টিনার সন্তান জন্মের পরে প্ল্যাসেন্টা বাদ যাওয়ায় ঝুঁকি এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেল। এর পরে অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দিলে বাকি ঝুঁকিটুকুও শেষ হবে বলে চিকিৎসকদের দাবি।
কিন্তু দ্রুত অস্ত্রোপচার না করে এমন রোগিণীকে সন্তানধারণ করানোর ঝুঁকি আদৌ নিলেন কেন ডাক্তাররা? আশিসবাবুর যুক্তি, “শুধু জীবন দেওয়া নয়, রোগীকে উন্নত মানের জীবন দেওয়াটাও চিকিৎসকের দায়িত্ব। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত অগ্রগতির পরেও যদি আমরা সেই দিশাটা দেখাতে না পারি, তা হলে আর সার্থকতা কোথায়?”
এখনও ভ্রান্তি...
• ক্যানসার মানে জীবন শেষ
• ক্যানসার ছোঁয়াচে রোগ
• গোড়ায় অঙ্গ ছেদ অনিবার্য
• মাতৃত্বহীন জীবন অসার
টিনা আর তাঁর চিকিৎসকদের এই যৌথ লড়াইকে স্বাগত জানিয়েছেন শহরের অন্য ক্যানসার চিকিৎসকরাও। নীলরতন সরকার হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের প্রধান সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “মনের জোরের এই উদাহরণগুলোই আশার আলো দেখায়। কেমোথেরাপির পরেও যে জীবন অপেক্ষা করে থাকে, এটাই মূল বার্তা।” ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “শুধু রোগিণী নয়, চিকিৎসকের মনের জোরটাও উল্লেখযোগ্য। তবে সবাই যদি নির্বিচারে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন, সেটা কিন্তু বিপজ্জনক হতে পারে। বাঁধা ফর্মুলায় চিকিৎসা না করে পরিস্থিতির বিশেষত্ব বুঝে এগোনোটা জরুরি।” চিকিৎসকদের আরও বক্তব্য ক্যানসার মানেই যেমন জীবনের শেষ নয়, তেমনই সন্তানহীনতাও হতে পারে না জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারানোর কারণ। যেনতেন প্রকারেণ সন্তানলাভ নয়, টিনার কাহিনিতে রোগকে প্রতিহত করার লড়াইটাই গুরুত্ব পাক, চাইছেন ওঁরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হুঁশিয়ারি, ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মহামারির আকার নেবে ক্যানসার। শুধু এ রাজ্যেই প্রতি বছর প্রায় ৭৫ হাজার নতুন ক্যানসার রোগীর হদিশ পাওয়া যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও এই রোগ নিয়ে সচেতনতা কতটা তলানিতে, তা টের পাওয়া গিয়েছে টিনার স্বামী, গোরার কথায়। তিনি জানান, স্ত্রীর অসুখ ধরা পড়ার পর বাড়ির লোকেরা ভেবেছিলেন, রোগটা হয়তো ছোঁয়াচে। চিকিৎসকেরা যখন কাউন্সেলিং শুরু করলেন, তখন ভয়টা কাটতে শুরু করল। গোরার কথায়, “ভাবতাম ক্যানসার রোগীর সঙ্গে থাকলে বোধহয় আমারও ক্যানসার হবে। এখন মনে হয়, কী বোকামিই না করেছি! বউ-বাচ্চাকে নিয়ে একেবারে নতুন জীবন শুরু হবে এ বার।”

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.