প্রবন্ধ ১...
মেয়েরা সুরক্ষা পেতে চায়, শাস্তি দিতে নয়
ব্রজদুলাল পাল, স্ত্রী অনিতা ও পুত্র রজত-সহ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেলেন। কারণ নাকি এই যে, তাঁর পুত্রবধূ নিমতা থানায় ৪৯৮এ ধারায় স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে পণের জন্য বধূ নির্যাতনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিলেন। সেই পরিবার শুনেছিলেন, পুলিশ তাঁদের খুঁজছে, ধরলেই থানায় পুরে দেবে। চার দিক থেকে রব উঠেছে, এই অবাঞ্ছিত মৃত্যুর জন্য দায়ী সেই পুত্রবধূ। এবং দায়ী ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৮এ ধারা। এই ধারার সংশোধন থেকে সম্পূর্ণ বিলোপ নানা মাত্রার দাবি আরও জোরদার হয়েছে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর।

সত্যি নাকি এই অভিযোগ? একটা জুতসই আইন পেয়ে মেয়েরা দলে দলে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়িকে ফাঁসানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে? প্রথমে পরিপ্রেক্ষিতটা দেখে নেওয়া যাক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এ দেশে প্রতি তিন জনে দু’জন মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। পারিবারিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ পারিবারিক হিংসা। রাষ্ট্রপুঞ্জের জনসংখ্যা তহবিল বলেছে, ৫৭ শতাংশ মেয়ে এখানে নির্যাতনের শিকার। ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো-র তথ্য বলছে, ২০১১ সালে পণের জন্য মারা গেছেন ৮৬১৮ জন গৃহবধূ। তার মানে, প্রতিদিন ২৩ জন মেয়ে মারা যাচ্ছেন। তাও এর মধ্যে পণের চাপে আত্মহত্যাকে ধরা হয়নি।
নিগৃহীতা! ‘দহন’ ছবির একটি দৃশ্য।
তার মানে একটা কথা পরিষ্কার। মেয়েরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এটা বানানো গল্প নয়। কিন্তু তার পরেও প্রশ্নটা একটু অন্য ভাবে উঠতেই পারে। অত্যাচার যত, অভিযোগ কি তার তুলনায় অনেক বেশি? বানানো? ফাঁপানো? ফোলানো? সাফ সাফ বলে দেওয়া যাক, বাস্তব একেবারে এর উল্টো। বিভিন্ন নারী সংগঠনের অভিজ্ঞতা, মেয়েরা ৪৯৮এ-তে মামলা দায়ের করতে চান না। ১৯৯৮ সালে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস প্রথম সমীক্ষা চালিয়ে বলে যে, তাদের কাছে যে গৃহবধূরা কাউন্সেলিং-এর জন্য এসেছেন, তাঁদের এক-তৃতীয়াংশেরও কম এই ধারায় মামলা দায়ের করতে চেয়েছেন। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতাও তাই। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৩ বলছে, ৪০ শতাংশ গৃহবধূ পারিবারিক হিংসার শিকার হলেও মাত্র ০.০৩ শতাংশ পুলিশে অভিযোগ করেন। পুলিশ যদি অভিযোগ শুনে বলে যে, অত্যাচারী স্বামীকে এনে উত্তমমধ্যম দেবে, তা হলে অত্যাচারিতা স্ত্রীরাই হাতেপায়ে ধরে বলেছেন, মারধর না করে যেন একটু বুঝিয়ে বলা হয়। সেই মেয়েরা জানেন যে, শ্বশুরবাড়ির আশ্রয় হারালে মাথা গোঁজার আর কোনও ঠাঁই নেই ছেলে-মেয়ে থাকলে তো আরও চিন্তা। ২০১১ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী মোট দায়ের করা মামলার (৬২৫২৭২৯) মাত্র ১.৬ শতাংশ হল স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে।
তবু সন্দেহ হচ্ছে? হতেও তো পারে যে, যাঁরা সত্যিই অত্যাচারিত তাঁরা নালিশ করছেন না, কিন্তু অন্য অনেকে দুরভিসন্ধিবশত মিথ্যে অভিযোগ আনছেন? তা হলে আর একটা হিসেব দিই। ৪৯৮এ ধারার মামলায় চার্জশিট হয়েছে ৯৪.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগের সারবত্তা পেয়েছে। বাকি ক্ষেত্রগুলিতে নানা কারণে চার্জশিট দেওয়া হয়নি, মামলা তুলে নেওয়া তার অন্যতম কারণ। চুরিডাকাতির মতো ঘটনাতেও (ধরনের উপর নির্ভর করে) যেখানে চার্জশিটের হার ৩৬ থেকে ৭২ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করে, সেখানে এই হার আর যা-ই হোক, মিথ্যে মামলার প্রবণতা দেখায় না। বরং, নারী সংগঠন বা সহৃদয় বহু মানুষের অভিজ্ঞতা হল, প্রকৃত নির্যাতনের ঘটনার থানায় ৪৯৮এ দায়ের করানো কী কঠিন। বিখ্যাত আইনজীবী ফ্লেভিয়া অ্যাগনেস বলছেন, নিম্ন আদালতের উকিলদের একাংশ আর পুলিশ এর অপব্যবহারের জন্য দায়ী। বিপরীতে এই ধারায় শাস্তির হার ছিল ২০১১ সালে ২০ শতাংশ, যেখানে সব ধরনের অপরাধ মিলিয়ে সারা ভারতে শাস্তির হার ৪১ শতাংশ। পুলিশ কি তা হলে নির্যাতিতার বাপের বাড়ির আর বিচারবিভাগ শ্বশুরবাড়ির? না হলে ৯৪.৪ শতাংশ ক্ষেত্রে চার্জশিট হয়ে কেন মাত্র ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি হয়? আসলে বহু ক্ষেত্রে বিচারবিভাগ মনে করে মেয়েদের একটু-আধটু মার খাওয়াই উচিত! নানা স্তরের বিচারকদের মধ্যে সমীক্ষা দেখেছে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা নিজের পরিবারের মেয়েদের মানিয়ে নিতে বলবেন। আবার, সুপ্রিম কোর্টের এক মহিলা বিচারক নিজের অবিবাহিতা কন্যাকে আয়করের খাতায় ‘দায়’ হিসেবে দেখিয়েছেন। এই বিচারকরাই দেশ জুড়ে বিচার করেন, তাই শাস্তির হার অবাক করে না। কিন্তু অধিকাংশ নিগৃহীতা তো প্রাথমিক ভাবে শাস্তি নয়, নিজের বা নিজেদের জন্য সুরক্ষা চান। তা তো ৪৯৮এ দিতে পারে না।
এই সব তথ্য সত্ত্বেও ২০০৩ সালে আইন কমিশন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া (যদিও ৬০০ পাতার রিপোর্টে ২৫০ পাতা সংযোজন আর প্রায় পঁচিশটি গবেষণাপত্র উল্লেখিত ছিল) ‘অপ’ব্যবহারের অভিযোগে এই ধারার সংশোধন সুপারিশ করেছে। আবার, ২০০১ সালে আইন কমিশন এবং ভারত সরকারের নারী ও শিশুবিকাশ মন্ত্রক এই ধারার যে ২,৩ ও ৪ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিকে লঘু করার বিষয়ে মত চেয়েছে!

যে মেয়েরা বিয়েটা ভাঙছে বলে ধরে নিয়েছেন, শুধু তাঁরাই ৪৯৮-এ ধারায় মামলা করতে চান, সে রকম মেয়ে এ দেশে এক শতাংশেরও কম। বাকিরা চান সুরক্ষাটুকু। রোজ রোজ মার খাওয়া থেকে বাঁচতে, ছেলেমেয়ের খাওয়ার-ইস্কুলের মাইনের-টিউশনির পয়সাটুকু হলেই তাঁরা এমনও বলেন: থাকুক না ও যাকে ইচ্ছে তাকে নিয়ে, আমাকে যেন ছেলেমেয়ের সামনে রোজ অপমান না করে। শুধু গৃহবধূরা নন, বাড়ির অংশ লিখে দেবার জন্য অবিবাহিতা বোনরা নিগৃহীতা হন না?
২০০৫ সালে পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে গৃহীত এই আইন ফৌজদারি নয় দেওয়ানি আইন। এতে শাস্তি দেওয়া নয়, নিগৃহীতার স্বার্থরক্ষাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে মেয়েদের থাকার জন্য বসবাসের অর্ডার, হিংসা আটকানোর জন্য ঘরে ঢুকতে না দেবার অর্ডার, খেতে পরতে না দেবার জন্য খোরপোষ অর্ডার, জিনিস ভাঙচুরের জন্য ক্ষতিপূরণের অর্ডার, থাকার জায়গা না থাকলে শেল্টারের অর্ডার, চিকিৎসার প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে পৌঁছনোর অর্ডার এ সব দেবার অধিকার ম্যাজিস্ট্রেটের আছে।
সেই অর্ডার লঙ্ঘিত হলে তবে আদালতের নির্দেশে পুলিশ আসবে, তার পরে গ্রেফতারের প্রশ্ন। এই আইনে শুধু গৃহবধূরা নয়, যে কোনও মেয়ে সুরক্ষা পেতে পারেন। এই আইনের জন্য যথেষ্ট সুরক্ষা অফিসার এবং ফোন নম্বর জনসমক্ষে আনা, তাঁদের শুধু চুক্তিভিক্তিক মাইনে নয়, ঘোরাঘুরির জন্য গাড়ি ও তেল, বিভিন্ন অর্ডারের কপি যথাসময়ে পাওয়া, অফিসের পিওন, শেল্টার হোম বা চিকিৎসা পরিষেবা কারা দেবেন তার তালিকা, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং দেবার মানুষের তালিকা, আর এই আইনে এক জন মেয়ে কী কী পেতে পারেন, তার তালিকা কি যথেষ্ট প্রচার হয়? থানায় গেলে কি নিগৃহীতা মেয়েটিকে পরামর্শ দেবার মানুষ থাকেন যে ৪৯৮-এ নয়, পারিবারিক সুরক্ষা আইনে প্রথম চেষ্টা করা হোক! এই আইনে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা আছে, তার জন্য জেলাওয়ারি লোক নিয়োগ হচ্ছে, তবে এখনও তা খুব অপ্রতুল। তবে এ পরামর্শ যেন পুলিশের দায় এড়ানো না হয়। দেখা দরকার যাতে এই আইনে অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, মামলার পাহাড় গড়ে না ওঠে! শুধু উত্তর ২৪ পরগনাতেই নাকি ২৫০০ মামলা জমে!

৪৯৮এ: একটি আইন, চারটি বৈশিষ্ট্য
১) শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতন-ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য;
২) এটি জামিন-অযোগ্য। মানে, থানা থেকে না, অভিযুক্তকে/দের হাজির করার পর আদালত থেকে জামিন পাওয়া যাবে;
৩) এটি নন-কম্পাউন্ডেবল, অর্থাৎ এক বার অভিযোগ দায়ের করলে তা ফেরত নেওয়া যাবে না;
৪) এটি কগনিজেবল্, অর্থাৎ আদালতের নির্দেশ ছাড়া পুলিশ তদন্ত প্রভৃতিতে এগোতে পারবে।

নতুন ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধনে তো গ্রেফতারি নিয়ে অনেক স্পষ্ট নির্দেশ আসছে, সেগুলো কেন কার্যকর করা হবে না? শুধু ৪৯৮এ ধারায় গ্রেফতারির কোনও গাইডলাইন আলাদা করে কার্যকর হবে না। পুলিশ প্রশাসন, নারী ও শিশুবিকাশ মন্ত্রক নারী কমিশনকে সামনে রেখে, নারী সংগঠনদের সঙ্গে নিয়ে নারী নিগ্রহে থানা কী করবে, মানসিক অত্যাচার বলতে কী বোঝাবে, কখন ৪৯৮এ আর কখন পারিবারিক হিংসা আইনে অভিযোগ দায়ের হবে, কোন ক্ষেত্রে কী করা হবে, তা নিয়ে কেন সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করবে না?
মেয়েরা সুরক্ষা পেতে চান, শাস্তি দিতে নয়। সুরক্ষা পেলে ‘শাস্তি দিয়ে দেখিয়ে দেব’ এই মনোভাব সুস্থ দাম্পত্যের ভিত্তি হতে পারে না। মহারাষ্ট্রে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’কে সামনে রেখে নারী সংগঠনদের সঙ্গে নিয়ে পুলিশ কাজ করেছে, করেছে
অন্ধ্রে, তামিলনাড়ুতে। এ রাজ্যের পুলিশ কেন পারবে না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.