পঞ্চাশোর্ধ্বে না হয় না-ই হইল, কিন্তু অশীতিপরেও কি বনং ব্রজেৎ নহে? লালকৃষ্ণ আডবাণী কী ভাবিতেছেন? কলিযুগে না হয় বানপ্রস্থের বয়স একটু বেশির দিকেই চলিয়াছে, তাহা বলিয়া কি সক্রিয় রাজনীতি হইতে বানপ্রস্থ গমনের বয়সের কোনও সীমা-পরিসীমাই থাকিবে না? বিজেপি দলের কোনও দ্বিতীয় সারির নেতা বা কোনও গোষ্ঠীও তাঁহাকে আর শীর্ষনেতা হিসাবে চাহেন না। সংঘ পরিবারও তাঁহার সঙ্গে নাই। এই অবস্থায় ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য তাঁহার এই মরিয়া, খিড়কি-দুয়ারি প্রয়াস দুর্ভাগ্যজনক। রাজনীতিতে বৃদ্ধতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাই হয়তো তাঁহাকে এখনও ‘লড়িয়া যাইতে’ প্ররোচিত করিতেছে। অশীতিপর হইলেও রাজনীতি হইতে সন্ন্যাসগ্রহণে অনিচ্ছুক নেতারা সব দলেই রহিয়াছেন। আডবাণীও একই কাজে প্রবৃত্ত। আপাতত তাঁহাকে লইয়া বিজেপি বেশ সমস্যায়। দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়া তিনি মাঝেমধ্যেই এমন কিছু মন্তব্য করিতেছেন (সর্বশেষ তাঁহার নিজের ‘ব্লগে’) কিংবা এমন কোনও আচরণ করিতেছেন (দুর্নীতিবিরোধী পদযাত্রা), যাহা দলকে যৎপরোনাস্তি অস্বস্তিতে ফেলিয়া দিতেছে। এমনই এক সাম্প্রতিক মন্তব্য ২০১৪ সালের নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করিতে গিয়া অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি রাজনীতিকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জল্পনা ভাসাইয়া দেওয়া। এতদ্দ্বারা আডবাণী হয়তো নরেন্দ্র মোদীর প্রার্থী-পদ বানচাল করিয়া নীতীশ কুমারের দাবি জোরালো করিতে উদ্যত। একই সঙ্গে নিজেকে ওই পদের দাবিদার রূপে তুলিয়া ধরার গোপন বাসনাও আর তত গোপন থাকিতেছে না, যদিও দল এ ব্যাপারে আপত্তির কথা জানাইয়া দিয়াছে।
তবে বর্ষীয়ান নেতা যে এখনও এত বড় দাবিদার রূপে প্রতিভাত, ইহা কিন্তু সম্ভব হইতেছে দলেরই সীমাবদ্ধতার কারণে। দেশের প্রধান বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও অটলবিহারী বাজপেয়ীর অবসরগ্রহণের পর হইতে বিজেপিতে কোনও সর্বজনগ্রাহ্য নেতা নাই। নরেন্দ্র মোদীকে যতই জাতীয় স্তরে তুলিয়া ধরার চেষ্টা চলুক, গুজরাতের বাহিরে দলেও তাঁহার কোনও গ্রহণযোগ্যতা নাই, দলের বাহিরে এনডিএ জোটে তো তিনি নীতীশ কুমারদের সংযুক্ত জনতা দলের কাছেও ব্রাত্য। বিজেপির বাকি নেতারা হয় সংবাদপত্রে-গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার নেতা, নতুবা প্রাদেশিক স্তরে বিভিন্ন জাত, উপ-জাত বা জনগোষ্ঠীর নেতা। এনডিএ-র সকল শরিকের কাছে কিংবা সমগ্র দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নেতার এই আকালই আডবাণীর মতো ফুরাইয়া-যাওয়া রাজনীতিককে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে দুঃসাহসী করিয়া তুলিতেছে।
সমস্যাটি একা বিজেপি বা এনডিএ-র, এমনও নয়। ইউপিএ ও তাহার মুখ্য সঞ্চালক কংগ্রেসও একই সমস্যায় দীর্ণ। রাহুল গাঁধীকে নেতৃপদে কবে অভিষিক্ত হইবেন, সেই পথপানে চাহিয়া অন্য কোনও দলীয় রাজনীতিকের দিকে যথেষ্ট দৃষ্টিপাত করিতেও অনিচ্ছুক কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্ব। রাহুলের এখনই উচ্চতর পদ ও গুরুতর দায়িত্ব পাওয়া উচিত কি না তাহা লইয়া দলের অভ্যন্তরেও যথেষ্ট সংশয়, কিন্তু প্রবীণ কংগ্রেস নেতারা সাধারণত সেই সংশয়ের কথা হাইকম্যান্ডের সামনে তুলিতেই সাহস করেন না। এ দিকে, স্পষ্টতই রাহুল নিজেও দল ও সরকারে আরও বেশি দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত, দ্বিধাগ্রস্ত তাঁহার মা কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গাঁধীও। রাহুলকে সামনে রাখিয়া বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের লড়াই যে শোচনীয় ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়, তাহার প্রেক্ষিতে এই দ্বিধা অস্বাভাবিকও নয়। অতএব মনমোহন সিংহের নেতৃত্ব সামনে রাখিয়াই হয়তো শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে ২০১৪-র নির্বাচন লড়িতে হইবে। নেতৃত্বের আকাল বাম দলগুলিতেও। সিপিআইএমে যেমন প্রকাশ কারাট ও সীতারাম ইয়েচুরিকে দিয়াই স্তালিনবাদী একটি সংগঠনের যাবতীয় তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনা ও সাংগঠনিক সমস্যা মিটাইবার চেষ্টা চলিয়াছে। থোড়-বড়ি-খাড়ার পুনরাবর্তনমূলক কল্পনাহীনতাই বুঝি ভারতীয় রাজনীতির ভবিতব্য। |