ভ্রূণ-লিঙ্গ পরীক্ষার গুপ্ত দাপটই
সামনে আনলেন রঞ্জনা
ইনে খামতি নেই। তবু লাগাম পড়েনি বে-আইনে। বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কলকাতা ও আশপাশে যে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে, বালির অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর অভিযোগের জেরে তা ফের সামনে এল। এ-ও প্রমাণ হয়ে গেল, হাজারো নির্দেশ-প্রচার-সচেতনতা কর্মসূচি সত্ত্বেও ভুক্তভোগী মহিলা সাহস করে এগিয়ে না-এলে স্বাস্থ্য দফতর বা পুলিশ মাথাই ঘামায় না!
রঞ্জনা প্রসাদ নামে ওই বধূর অভিযোগ: তিনি অন্তঃসত্ত্বা হলেই গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ পরীক্ষা করাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ আসত। এমনকী, রাজি না-হলে মারধরও করা হত। রঞ্জনার অভিযোগ, ২০১০-এ লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষার পরে তাঁর গর্ভপাতও করানো হয়েছিল। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি ও দেওরকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ-কর্তাদের অনেকেই বলছেন, রঞ্জনা ও তাঁর স্বামী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলেই ঘটনাটি প্রকাশ্যে এসেছে। এবং এ ভাবে এগিয়ে না-আসায় এমন অজস্র ঘটনা যে নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে, স্বাস্থ্য-কর্তারাও তা মানছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশাসন কি নিছক দর্শক মাত্র?
স্বাস্থ্য-কর্তাদের বক্তব্য: নিয়ম-কানুনের অভাব নেই। অধিকাংশ ক্লিনিকে লিঙ্গ নির্ধারণে নিষেধাজ্ঞা সংবলিত বোর্ড টাঙানো থাকে, নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানোও হয়। তবে ওখানেই শেষ। তার পরে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। ফলে ‘প্রি ন্যাটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিক্স অ্যাক্ট’ (পিএনডিটি)-এর তোয়াক্কা না-করে বহু জায়গাতেই বছরের পর বছর এই বেআইনি ব্যবসা চলে আসছে। রঞ্জনাদেবীর গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ কোথায় হয়েছিল?
সেই ক্লিনিকটিকে পুলিশ এখনও চিহ্নিত করে উঠতে পারেনি। পারলেও কি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেত?
প্রশ্নটা উঠছে, কারণ নিয়ম ভাঙার অভিযোগে গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য দফতর একশোরও বেশি ক্লিনিক সিল করেছে। কিন্তু সেগুলির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হল, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য স্বাস্থ্য-কর্তাদের কাছে নেই। অভিযোগ, ওগুলোর বেশ ক’টিতে সন্ধের পরে ভ্রূণ-লিঙ্গ নির্ধারণের কারবার চলছে। স্বাস্থ্য প্রশাসন কী করছে?
রঞ্জনার সঙ্গে সুনন্দাদেবী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর জবাব, “দফতর ওই সব ক্লিনিক সিল করে দিয়েছিল। পরে সেগুলো আবার চালু হল কি না, সে দিকে নজরদারির পরিকাঠামো আমাদের নেই। ওটা জেলা প্রশাসন ও পুলিশের দায়িত্ব।”
অর্থাৎ নজরের আড়ালে ‘নিয়মিত অনিয়মের’ সম্ভাবনা প্রভূত। রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ একটা সামাজিক ব্যাধি। শুধু আইন করে তা রোখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া আইনও আরও কঠোর হওয়া দরকার।” সুনন্দাদেবীর আক্ষেপ “অন্য ভাবে অত্যাচারিত হলে মেয়েরা তাঁদের মা কিংবা অন্য মহিলাদের জানান। অথচ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ ও কন্যাভ্রূণ নষ্টের কথা কেন বলেন না, সেটা আশ্চর্যের।”
সুনন্দাদেবী ও কমিশনের আর এক সদস্যা মঙ্গলবার সকালে লেকটাউনে রঞ্জনাদেবীর বাপের বাড়িতে যান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দুই আধিকারিক ও হাওড়ার মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক। রঞ্জনা তাঁদের জানান, ২০১০ সালে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে জোর করে যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ ও গর্ভপাত করিয়েছিলেন, সেটি কলকাতায়। কী ভাবে বুঝলেন?
বাপের বাড়িতে তিন বছরের মেয়ে আরিশাকে নিয়ে খাটে বসে ছিলেন বছর ঊনত্রিশের বধূটি। মুখে-চোখে আতঙ্কের ছাপ। বললেন, “সে দিন আমাকে জবরদস্তি গাড়িতে তুলে বালি থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কী একটা ইঞ্জেকশন দিল, তাতে প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়লাম। তবে হাওড়া ব্রিজ পেরোনোটা টের পেয়েছিলাম।” তাঁর আরও অভিযোগ, বাড়ি ফেরার পরে তিনি জানতে পারেন, গর্ভে কন্যাসন্তান থাকায় তাঁর গর্ভপাত করানো হয়েছে। রঞ্জনার দাবি, পরে জায়গাটা চেনানোর জন্য তাঁর স্বামী রবীন্দ্র তাঁকে কলকাতার বেশ ক’টা হাসপাতাল-নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি চিনতে পারেননি।
রঞ্জনা জানান, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরেই তাঁকে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য চাপ দিতে থাকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। তিনি ও তাঁর স্বামী রাজি না-হওয়ায় অত্যাচার শুরু হয়। “২০১০-এর ওই সময়ে স্বামী ব্যবসার কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। সেই ফাঁকে ওরা আমার গর্ভপাত করায়। এ বার সেই ভয়েই স্বামী দূরে কোথাও যাননি। কিন্তু গত ২ অগস্ট কিছুক্ষণের জন্য উনি বাড়ির বাইরে যেতেই ওরা আমায় মারধর শুরু করে।” বলেন রঞ্জনা।
অনিয়মই নিয়ম
আইনে আছে
• ক্লিনিক ও সোনোলজিস্টের রেজিস্ট্রেশন যাচাই।
• অন্তঃসত্ত্বা ও ডাক্তারের নাম-ঠিকানা দিয়ে ফর্ম ‘এফ’ পূরণ।
• ফর্মে রেফারের কারণ উল্লেখও আবশ্যিক।
• স্বাস্থ্য দফতরে ফর্ম পরীক্ষা, ক্লিনিক পরিদর্শন।
• একই সোনোলজিস্ট জেলায় দু’টির বেশি ক্লিনিকে নয়।
• ক্লিনিকে ‘ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ আইনত দণ্ডনীয়’ বোর্ড।

বাস্তবের ছবি
• বছরে এক বারও পরিদর্শন হয় কি না সন্দেহ।
• ফর্ম ‘এফ’ নাম-কা-ওয়াস্তে, পরীক্ষা কদাচিৎ।
• অন্তঃসত্ত্বাদের সঙ্গে যোগাযোগের বালাই নেই।

আইন ভাঙলে
• সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
ছবি: হিলটন ঘোষ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.