ফৌজদারি মামলায় পুলিশ যাতে সময়ে চার্জশিট জমা দিতে পারে, সে জন্য পশ্চিমবঙ্গের প্রতি মহকুমায় একটি করে মামলা তদারকি কমিটি (ট্রায়াল মনিটরিং কমিটি) গঠনের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসন। তাদের দাবি, প্রত্যেক অপরাধীকে যোগ্য শাস্তিদানের লক্ষ্যেই এই পদক্ষেপ। কিন্তু যেখানে তদন্তকারী অফিসারেরই বিস্তর অভাব, সেখানে এই প্রয়াস কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে পুলিশমহলেই সংশয় দেখা দিয়েছে।
অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল পুলিশের তরফে চার্জশিটের মাধ্যমে মামলাকে আদালতের দরজায় পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে খুব কম সংখ্যক ফৌজদারি মামলায় পুলিশ ঠিক সময়ে চার্জশিট পেশ করতে পারে। ফলে এ রাজ্যে খুব কম অভিযুক্তেরই শাস্তি হয় বলে সরকারি পরিসংখ্যানে জানা যাচ্ছে। কী রকম?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১৯% মামলায় অভিযুক্তের সাজা হয়েছে। এই নিরিখে ঝাড়খণ্ড-পঞ্জাব-রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ এ রাজ্যের তুলনায় এগিয়ে। এমনকী, যার উদাহরণ টেনে আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে ‘মরূদ্যান’ বলা হতো, সেই বিহারও অপরাধীকে শাস্তিদানের বিচারে পশ্চিমবঙ্গকে বেশ পিছনে ফেলে দিয়েছে। এবং চার্জশিট পেশে পুলিশি-ব্যর্থতাই শাস্তিদানের দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গের এ ভাবে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। সরকারি সূত্রের তথ্য: গত বছরে পশ্চিমবঙ্গে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৩১ হাজারটিতে চার্জশিট দিতে পেরেছিল পুলিশ। অর্থাৎ মাত্র ৬০% মামলায়।
এই পরিস্থিতিরই মোকাবিলায় মহকুমাপিছু মামলা তদারকি কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত।
এক পুলিশকর্তার কথায়, “জেলা সদরে এক জন ইন্সপেক্টরকে ‘নোডাল অফিসার’ করে এসপি-রা ওই কমিটি তৈরি করেছেন। নোডাল অফিসারেরা কোর্টে হাজির থেকে বিভিন্ন মামলার তথ্য জোগাড় করে দৈনিক রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন মহাকরণে।”
কিন্তু দ্রুত তদন্ত শেষ করার বন্দোবস্ত না-করে শুধু তদারকি কমিটি বানিয়ে কতটা লাভ হবে? পুলিশ-কর্তাদেরই একাংশ এই প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য: অভিযুক্তের সাজা পাওয়ার ব্যাপারটা যেমন অনেকটা আদালতের উপরে নির্ভরশীল, তেমন পুলিশকেও আটঘাট বেঁধে নথিপত্র বানাতে হয়। যাবতীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ যাতে পুলিশের পক্ষে যায়, তদন্তকারীদের সে দিকেও নজর দিতে হয়। অথচ এখানেই সমস্যা দিন দিন জটিল হচ্ছে। কেন?
কারণ, তদন্তের জন্য সময়াভাব এবং তদন্তকারী অফিসারের অভাব। পুলিশ-কর্তাদের আক্ষেপ, এক-একটা মামলায় তিন মাসে তদন্ত সেরে চার্জশিট পেশ করতে তদন্তকারী অফিসারের যে সময় দেওয়া উচিত, দৈনন্দিন আইন-শৃঙ্খলার ডিউটি সেরে তার সিকি ভাগও তাঁরা পাচ্ছেন না। যে কারণে পুলিশ কমিশনের সুপারিশ ছিল, থানায় কর্তব্যরত পুলিশের একাংশকে শুধু তদন্তের কাজেই লাগানো উচিত। অন্য অংশ সামলাবে আইন-শৃঙ্খলা। যদিও রাজ্যের পূর্বতন সরকার সেই সুপারিশ মানেনি। এখনও মান্ধাতা পদ্ধতিতেই থানা চলছে।
একই ভাবে তদন্ত চালানোর যোগ্যতাসম্পন্ন অফিসারের সংখ্যাতেও প্রবল ঘাটতি। পুলিশ-সূত্রের খবর: ফৌজদারি মামলার তদন্ত করেন মূলত সাব ইন্সপেক্টরেরা (এসআই)। রাজ্যে যেখানে ৪৯৪৫ জন এসআই থাকার কথা, সেখানে আছেন ৩৬৪৫ জন। অর্থাৎ, অনুমোদিত পদের চেয়ে ১৩০০ কম। ফলে এক-এক জনের হাতে গড়ে দেড়শো তদন্ত জমে রয়েছে। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর থানা। সেখানে এসআই সাত জন, তদন্ত বকেয়া সাতশোরও বেশি। হাওড়ার আমতা কিংবা হুগলির গোঘাটেও এক অবস্থা। কলকাতার দূরবর্তী জেলাগুলোর হাল অবস্থা আরও করুণ। যেমন মুর্শিদাবাদে মামলার সংখ্যা সাড়ে ছ’হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে,অথচ তদন্তকারী অফিসার সাকুল্যে ১২২ জন! বর্ধমানে ১২০ জন এসআইয়ের হাতে সাড়ে চার হাজার মামলার তদন্তভার!
এ দিকে মামলার চাপ দিন দিন বাড়ছে। একাধিক পুলিশ-কর্তার মতে, মানুষ যত সচেতন হচ্ছেন, তত বাড়ছে নথিভুক্ত অভিযোগের সংখ্যা। এই চাপ সামলাতে বছরখানেক আগে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর (এএসআই)-দের তদন্ত করার ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুরাহা হয়নি। কেননা এএসআই-ও বাড়ন্ত। বর্তমানে অনুমোদিত পদের তুলনায় এএসআইয়ের সংখ্যা ১৮০০ কম। উপরন্তু রয়েছে যোগ্যতার অভাব। এক পুলিশ-কর্তার ব্যাখ্যা, “এএসআই পদে সরাসরি নিয়োগ হয় না। কনস্টেবলেরা পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হন। কনস্টেবল নিয়োগে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি হওয়ায় তদন্তের কাজে অধিকাংশের দক্ষতা থাকছে না।”
এই পরিস্থিতিতে সব মামলায় দ্রুত তদন্ত সেরে চার্জশিট দেওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়ে পুলিশমহলেই সংশয় জেগেছে। |