সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এ রাজ্যের পাহাড়ে বাংলা ভাষা থাকবে না?’ (১৮-৭)। তাঁর আশঙ্কার কারণ, ‘মাঝে মাঝেই পাহাড়ি নেতাদের কেউ কেউ বলে ফেলছেন, গোর্খাল্যান্ডের দাবি তাঁরা আপাতত মুলতুবি রাখছেন বটে, কিন্তু সেই মূল দাবি থেকে একটুও সরছেন না। এই উক্তির একটু গূঢ় অর্থ এই হতে পারে যে, মুলতুবির এ সময় তাঁরা ভিতরে ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন।’
আমাদের গণতন্ত্রের শিক্ষা হচ্ছে, বিরোধী অবস্থায় যাঁরা যতই বড় বড় কথা বলুন না কেন, ক্ষমতায় গিয়ে সেই তাঁদেরই প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। যেমন, এ রাজ্যের পূর্বতন মার্ক্সবাদী শাসকদের দলীয় ইস্তাহার এখনও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্কল্পে প্রোজ্জ্বল!
গোর্খারাও যাতে নয়া ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গীকৃত হয়ে যেতে পারেন তার জন্য অবশ্য সমতলেরও দায়িত্ব আছে। পূর্বতন শাসকরা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ তকমা দিয়ে গোর্খাদের বিচ্ছিন্নতার দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। বাংলার নয়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের কোলে টেনে নিয়ে সৌহার্দের বাতাবরণ তৈরি করে দিয়েছেন। গোর্খারাও তাঁকে ‘মা’ বলে গ্রহণ করেছেন। এই সময় সুনীলবাবু ‘বাঘনখ’-এর কথাটা পেড়ে তাঁদের দুঃখ না-দিলেই পারতেন।
সুনীলবাবুর আরও অভিযোগ, ‘দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে মাঝে মাঝে দেখি, পাহাড়ের বিশিষ্ট নেতারা সরকারপক্ষের বিভিন্ন মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলছেন হিন্দিতে কিংবা ইংরেজিতে। তাঁরা একটাও বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেন না।’
সুনীলবাবুর এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সহমত হওয়া গেল না। পাহাড়ের বিশিষ্ট নেতারা ভালই বাংলা বলেন। হড়কা বাহাদুর যথেষ্ট ভাল বলেন। রোশন গিরি মাঝারি ধরনের, গুরুং একটু কম। এটা ভাষা-দক্ষতার প্রশ্ন, বিরাগের নয়। পর্যটন পাহাড়ের প্রধান ব্যবসা। পর্যটকদের বড় অংশ বাংলাভাষী। গোর্খারা বাংলা ভাষার প্রতি বিরাগ দেখাবেন কেন? দার্জিলিঙে তো বটেই, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে গিয়েও দেখেছি, গোর্খারা ভালই বাংলা বলেন। তবে, সুনীলবাবু যে ভাবে বাংলা ভাষা শিক্ষা আবশ্যিক করতে বলেছেন, সেটা বোধহয় উচিত হবে না। পাহাড়ে স্বায়ত্তশাসনের অন্যতম লক্ষ্য, গোর্খাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ। বিষয়টা গোর্খাদের উপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল।
বাংলা ভাষার প্রতি বিরাগ বরং প্রকট হচ্ছে বাঙালিদের মধ্যেই। এই শহরের পথে-ঘাটে যে ভাবে বঙ্গসন্তানদের বিজাতীয় ভাষায় বাক্যালাপ করতে দেখি, তাতে ধিক্কার হয়। পাহাড়ে বাংলা ভাষা থাকবে কি না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন সমতলে থাকবে তো?
দীনবন্ধু সামন্ত। কলকাতা-৬৪ |